কারিগরি শিক্ষা কিভাবে অর্থনীতি উন্নয়নে আরও বেশি ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে পারে?
2022-02-14 18:11:24

বিগত কয়েক বছর ধরেই চীনে কারিগরি শিক্ষার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এখন অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরিবর্তে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে সংশ্লিষ্ট পেশার জন্য দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হচ্ছে। আজকের আসরে আমরা কারিগরি শিক্ষার ইতিবাচক দিক এবং দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে এর অবদান নিয়ে আলোচনা করবো।

চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের মেইচৌ শহরের কারিগরি স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর বর্তমানে চংশান শহরের একটি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন চাং চিন খুন। তার মাসিক বেতন ১০ হাজার ইউয়ানের বেশি, যা স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর চেয়েও বেশি। আজকাল দক্ষ কর্মীদের চাহিদা বেড়েছে। যাদের কর্মদক্ষতা ভালো, তাদের বেতনও ভালো। আসলে চাং চিন খুনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই এমন একটি চাকরি তার জন্যে অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে কয়েক বছর আগে চাংয়ের মতো কর্মীদের বেতন এতো ভালো ছিল না। অধিকাংশ কারিগরি স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্নাতক হওয়ার পর মাসিক ৩০০০ ইউয়ান বেতনে কাজ করতে বাধ্য হতেন।

চীনের সমাজে কিছু অসঙ্গতিও দেখা যায়। দেশে দক্ষ প্রযুক্তিবিদের অভাব আছে। অথচ কারিগরি শিক্ষার প্রতি এতোদিন ঠিক সুবিচার করা হচ্ছিল না। অথচ কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন ঘটালে চীনের অর্থনীতি লাভবান হবে। এখন কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন একটি বড় কাজ।

কুয়াংতুং প্রদেশের মেইচৌ কারিগরি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শীতের ছুটি শুরু হয়েছে। কিন্তু ছুটির প্রথম দিকে শিক্ষকরা সেমিস্টারের শেষ দিকের কিছু কাজ করেন। স্কুলের শিক্ষক লি স্যুয়ে হং বলেন, নতুন সেমিস্টারের কাজ ও মেইচৌ উদ্যান মেলার চারটি শাখা বিভাগের নির্মাণকাজের প্রস্তুতি নিতে হবে। এর লক্ষ্য নতুন সেমিস্টারের কাজ সুশৃঙ্খলভাবে চালানো।

মেইচৌ কারিগরি স্কুল শহরের প্রথম সরকারি কারিগরি স্কুল। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে কুয়াংতুং প্রদেশের ১১টি নতুন স্কুলের সাথে এটিও চালু হয়। স্কুলে কৃষি প্রকৌশল, এআই প্রকৌশল, বিদ্যুত্ ও মেশিন প্রকৌশলসহ ৫টি প্রধান মেজর রয়েছে। নতুন স্কুলে প্রথম বছরে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ৫২৩ জন। তবে শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্য ছিল এক হাজারের বেশি। সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এর একটি কারণ, নতুন স্কুল সম্পর্কে অনেকেই জানতেন না। শিক্ষক লি মনে করেন, মেইচৌ কারিগরি স্কুল স্থানীয় কারিগরি শিক্ষার অভাব দূর করেছে।

বর্তমানে মেইচৌ শহরে উচ্চশিক্ষার কারিগরি স্কুল একটি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিগরি স্কুলের সংখ্যা ১২টি। আর এসব স্কুলের শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ২৪ হাজারেরও বেশি। যদিও কারিগরি স্কুলের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং স্কুলের শিক্ষকদের যোগ্যতার ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, তবে শহরের উন্নয়ন ও শিল্প রূপান্তরের চাহিদা বিবেচনা করলে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ ব্যক্তির অভাব রয়েই গেছে। কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের গতিও যেন আশানুরূপ নয়। এ সম্পর্কে মেইচৌ শহরের মেইসিয়ান এলাকার কারিগরি স্কুলের প্রেসিডেন্ট ম্যাডাম ইয়ু স্যুয়ে ফান বলেন, মেইচৌ এলাকার অর্থনীতির উন্নয়নের গতি কুয়াংতুং প্রদেশের অন্যান্য জায়গার চেয়ে ধীর। এখানকার কারিগরি শিক্ষা উন্নত করতে শিক্ষা-উপকরণ আরও উন্নত করা প্রয়োজন, বাজেট বাড়ানো দরকার।

গত শতাব্দীর শেষ দিকে চীনের শিল্প অর্থনীতি দ্রুত উন্নত হয়। ফলে মেইচৌ শহরের বিভিন্ন পেশার কারিগরি স্কুলের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সেই সময় সিএনসি পেশাদার বিভাগ সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। স্কুলের প্রতি ব্যাপকভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হয় এবং এখান থেকে ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষার্থীরা ভালো চাকরিও পেতে শুরু করে।

তবে বিভিন্ন কারিগরি স্কুলে একই মেজর চালু হবার পর থেকে স্কুলগুলোর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়। নতুন শতাব্দীতে মেইচৌ শহরের শিল্পের রূপান্তর ঘটেছে; এখন আর সিএনসি পেশাদার লাগে না, শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোও এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করে ও ধীরে ধীরে অটোমেশানের দিকে যেতে থাকে। ফলে এক বছরের মধ্যে সিএনসি বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক ডজনে নেমে আসে; এই বিভাগের শিক্ষকের সংখ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যার তুলনায় বেশি হয়ে যায়।

চীনে ‘দুই সন্তান নীত’ চালু হবার পর, বিভিন্ন কারিগরি স্কুলে কিন্ডারগার্টেন নর্মোল, পর্যটন প্রশাসন ও সেক্রেটারিসহ বিভিন্ন মেজরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের শিক্ষা বিভাগ থেকে কারিগরি স্কুলগুলোর মেজর সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। ফলে, বিভিন্ন স্কুল নিজেদের মতো মেজর ঠিক করে, যা স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ও শিল্প চেইনের চাহিদার সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। এতে বিভিন্ন কারিগরি স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়েও নানান সমস্যা দেখা দেয়।

কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ কর্মীর অভাব হলে সেরা পর্যায়ের প্রক্রিয়াকরণ শিল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাই সেরা ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের জন্য শ্রেষ্ঠ কারিগরি স্কুল প্রয়োজন। সমস্যা আরেকটি আছে। অতীতকাল থেকেই এমন একটা ধারণা মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল যে, লেখাপড়ায় তুলনামূলকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরাই কারিগরি স্কুলে ভর্তি হয়। এমন ভুল ধারণার কারণে অনেক সেরা ছাত্রছাত্রী কারিগরি স্কুলে ভর্তি হতে উত্সাহিত হতো না। বিশেষ করে, গত কয়েক দশকের চিত্রটা ছিল এমন: উচ্চ বিদ্যালয়ে ভালো করা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।

যদিও সরকারি পর্যায় থেকে কারিগরি শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য না-করার কথা বলা হয়েছে বা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট পিতামাতা ও শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষার প্রতি সেভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে না। সেরা শিক্ষার্থীর অভাব হলে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকও পাওয়া যাবে না। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সমস্যা আছে। অথচ কারিগরি শিক্ষার শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা বেশি জরুরি। ভালো শিক্ষক কমে গেলে ভালো শিক্ষক তৈরির ধারাও বন্ধ হয়ে যাবে। এটা একটা বড় সমস্যা।

শিক্ষক হৌ চি মিন কুয়াংতুং প্রদেশের শিক্ষা বিভাগের কর্মদলের সাথে কারিগরি শিক্ষার উন্নত তত্ত্ব ও পদ্ধতি শিখতে জার্মানি সফর করেন। জার্মানি বিশ্বের উন্নত শিল্পরাষ্ট্র। সেখানকার দ্বৈত ব্যবস্থার শিক্ষা বৈশিষ্ট্যময়। জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন আছে, তেমনি আছে দেশে বিভিন্ন কারিগরি স্কুল। সেদেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অনুশীলন এবং কারিগরি স্কুলের তত্ত্ব ও  প্রশিক্ষণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

এ সম্পর্কে শিক্ষক হৌ বলেন, জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাচ্চারা ছোটবেলা থেকে কারিগরি দক্ষতা অর্জনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। সেদেশে কারিগরি স্কুলের শিক্ষকদের বেতনও বেশ ভালো। সেই জন্যে জার্মান ম্যানুফ্যাকচারিং অনেক উন্নত এবং বিশ্বে বিখ্যাত।

কারিগরি শিক্ষার দুটি লক্ষ্য রয়েছে: শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ এবং দেশের শিল্পের উন্নয়ন। চীনের অভিন্ন সমৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে কারিগরি শিক্ষার বিরাট উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে সংস্কারব্যবস্থা চালু হয়। চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের প্রকাশিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কারিগরি শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা দু’ধরনের শিক্ষা। এ দু’ধরনের শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব ও সম্মান দিতে হবে। তখন থেকে কারিগরি শিক্ষার  বিধিও সংশোধন করা হয়েছে, যা কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের দরজা খুলে দিয়েছে।

 

উহান শহরের সেরা কারিগর উ সিন হুয়া’র গল্প

উহান পরিবহন স্কুলের শিক্ষক উ সিন হুয়া চীনের হুপেই প্রদেশের ‘পয়লা মে’ পুরস্কার বিজয়ী ও চীনের সেরা ঢালাইকারী। তিনি বহু বছর ধরে দেশের সেরা ঢালাইকারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। এ পর্যন্ত তার ৪০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছে। আমরা শিক্ষক উ’র গল্প তুলে ধরবো।

২০০০ সালে ১৮ বছর বয়সের শিক্ষক উ উচ্চবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর উছাং জাহাজ গ্রুপের লিমিডেট কোম্পানিতে যোগ দেন। তুমুল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হলেও তিনি প্রাণশক্তি দিয়ে নিজের কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে যান। ৭ বছর বিভিন্ন কারিগরি প্রতিযোগিতায় তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পুরস্কার লাভ করেন এবং ২০০৮ সালে ২৬ বছর বয়সের উ সিন হুয়া কোম্পানির সবচেয়ে জুনিয়র উচ্চশ্রেণীর প্রযুক্তিবিদ ও কারখানার দলের প্রধানে পরিণত হন।

২০১১ সালে ব্যস্ত কর্মজীবনের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তিনি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার তাঁর উচ্চবিদ্যালয়ে ফিরে যান এবং একজন শিক্ষক হিসেবে শূন্য থেকে কাজ শুরু করেন। তখন স্কুলের প্রেসিডেন্ট চিয়ান ইয়ু লিন তাঁকে বলেন, কারিগরির সেরা ব্যক্তিদের মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন। তাই দেশের জন্য আরো বেশি সেরা শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে তাকে।

তখন থেকে টানা ১০ বছর ধরে শিক্ষকতার কাজ করছেন শিক্ষক উ। তাঁর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, কারিগরি স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচ্চ বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে সহজ ব্যাপার নয়। কারণ, কারগরি স্কুলের শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ একটু বিদ্রোহী ধরনের। তাদের লেখাপড়ার উত্সাহ কম। তাই কারিগরি প্রশিক্ষণের মজার মজার দিকগুলো তুলে ধরতে হয় তাদের সামনে। আর এভাবেই তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন তিনি।

প্রতিটি নতুন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তাদের সাথে খেলাধুলা করেন তিনি। যেমন, তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে গেমস খেলেন বা কথাবার্তা বলেন। এভাবে শিক্ষার্থীরা তাকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দেখে।

তা ছাড়া, প্রতিটি ক্লাসে তিনি নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের প্রশংসা করেন। যদি শিক্ষার্থীরা তাদের ভুল সংশোধন করে, তাহলে তিনি অবশ্যই ইতিবাচক স্বীকৃতি দেন।

বর্তমানে মোবাইল ফোন শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ। তাই ক্লাসে তাদের মোবাইল সংগ্রহ করে নিজের কাছে রাখেন তিনি। তবে, শুরুর দিকে কেউ তা জমা দিতে চাইত না। ধীরে ধীরে শিক্ষক উ’র কঠোর নিয়ম তারা মেনে নেয়।

গত ১০ বছরে তিনি মোট ৪০ জনেরও বেশি দক্ষ ঢালাইকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছেন। সেটি শিক্ষক উ’র জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার।

১০ বছর আগে অসুস্থতার কারণে তিনি শিক্ষকের কাজ বেছে নিয়েছিলেন। তবে ১০ বছর পর তিনি মন থেকেই শিক্ষকতার কাজ করছেন। তার মনে এখন আর কোনো দুঃখবোধ নেই। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)