বাংলাদেশের মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকে অমর একুশে গ্রন্থমেলার জন্য। ফেব্রুয়ারি জুড়ে বইমেলাটি লেখক-পাঠক-প্রকাশকের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। আজ বাঙালি সংস্কৃতির এক প্রধান অনুষঙ্গে হয়ে উঠেছে মেলাটি।
করোনা-কারণে দু’সপ্তাহ বিলম্বে হলেও অবশেষে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে বইমেলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওইদিন ভার্চুয়ালি মেলার উদ্বোধন করবেন। সরকারের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেলা চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। যদিও প্রকাশকদের দাবি ১৭ মার্চ পর্যন্ত মেলা চালানোর। সরকারের তরফে বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। সবকিছু নির্ভর করবে করোনা পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়- তার ওপর।
করোনা কারণে গত বছরও বইমেলা বিঘ্নিত হয়। করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে কমিয়ে দেওয়া হয় মেলার সময়সীমা। সবকিছু মিলিয়ে খুব জমে উঠতে পারেনি গতবছরের মেলাটি। প্রকাশকদের আশা ছিল করোনার ক্ষতি তারা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবেন বইমেলায়। কিন্তু কার্যত তা আশানুরূপ হয়নি। তুব মেলা বসেছিল, লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের সমাগম ঘটেছিল, ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশনা শিল্পে কিছুটা হলেও প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল।
এবারো বছরের শুরুতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া যথাসময়ে মেলা শুরু নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। হয়েছেও তাই। ফেব্রুয়ারির শুরুতে মেলা শুরু করা যায়নি। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ঘোষণা দেন ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে বইমেলা। মেলার থিম ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’।
এদিকে, মেলা শুরুর তারিখ ঘোষণার আগে থেকেই চলছিল প্রস্তুতি। স্টল নির্মাণ কাজ অবশ্য স্থগিত হয়ে যায় তারিখ ঘোষণার বিলম্বে। এখন তারিখ ঘোষণার পর তড়িঘড়ি করে স্টল নির্মাণ কাজ শেষ করবার চেষ্টা চলবে। এবারের মেলার নকশাকার স্থপতি এনামুল কবির নির্ঝরের সংশয় যথাসময়ে স্টলনির্মাণ ও সাজসজ্জার কাজ শেষ করা যাবে কি-না। বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতারও অভিযোগ রয়েছে তার।
এবার মেলায় পাঁচ শো’র বেশি প্রতিষ্ঠানের আট শো ইউনিটের বেশি স্টল থাকছে। ৩৬টি প্যাভিলিয়ন থাকছে মেলায়। বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলিয়ে মেলার পরিসর হবে সাড়ে ৭ লাখ বর্গফুট। মেলার সদস্যসচিব জালাল আহমেদ জানিয়েছেন বাড়তে পারে স্টল সংখ্যা।
মেলা ঘিরে এখন কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের মনে।
এক. মেলার সময়সীমা বাড়বে তো?
দুই. করোনায় স্বাস্থ্যবিধি কতোটা মানা হবে?
তিন. কেমন হবে জনসমাগম?
চার. বেচাবিক্রি কেমন হবে?
পাঁচ: কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে দেশের প্রকাশনা শিল্প?
প্রকাশক সমিতিসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আশা মেয়াদ বাড়বে মেলার। তবে সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ মেলা শুরুর তারিখ ঘোষণা করলেও সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে কিছু জানাননি। করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে বিষয়টা সরকার বিবেচনা করবে বলে আভাস দেন তিনি। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার বক্তব্য- যথাসময়ে মেলা শুরু করাটাই এখন প্রধান বিবেচ্য। তবে বোদ্ধা মহল মনে করছে- করোনা পরিস্থিতির খুব অবনতি না হলে মেলার সময়সীমা বাড়তে পারে।
বইমেলায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে আগে থেকেই বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ কিছু উদ্যোগ নেয়। এ জন্য বইমেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাডেমির সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী, লেখক, প্রকাশক, বিক্রেতা, স্টলের কর্মচারীসহ মেলা সংশ্লিষ্ট সব কর্মীকে টিকা গ্রহণসহ বয়স্কদের প্রয়োজনমতো বুস্টার ডোজ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক একাডেমি প্রাঙ্গনে টিকা প্রদান বুথ স্থাপনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বাংলাদেশে আসন্ন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছ। ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, বইমেলায় ক্রেতা বিক্রেতা সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। বইমেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের টিকার সনদ না থাকলে জরিমানা করা হবে। বইমেলার প্রবেশপথে তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা থাকবে এবং মাস্ক ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। প্রবেশ করলেও বের করে দেয়া হবে।
বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ও ডিএমপি স্বাস্থ্যবিধির ওপর জোর দিচ্ছে এটা ভালো কথা। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু থাকবে সেটা দেখবার বিষয়। এখানে একটা উভয় সংকট অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেমি করলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা। আর বেশি কড়াকড়ি করলে লোকসমাগম কম হতে পারে। সেক্ষেত্রে শ্যাম-কুল দুটোই রক্ষা পায় এমন মধ্যপন্থা গ্রহণই শ্রেয় বলে মত অভিজ্ঞ মহলের।
সব পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে মেলায় জনসমাগম হবে। আর তা হলে বেচা-বিক্রিও ভালো হবে। এতে দেশের প্রকাশনা শিল্প কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে- এমনটা আশা করাই যায়।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।