যদি রাজধানীর ঢাকার বাসিন্দাদের জিজ্ঞেসা করা হয়- দেশের করোনা পরিস্থিতির কি অবস্থা?- তবে উত্তর দিতে অনেকেই বিপদে পড়বেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিনের যারা খোঁজ রাখেন না, বা যারা নিয়মিত খবরের কাগজ কিংবা রেডিও-টিভিতে করোনা সংক্রান্ত খবরে কান পাতেন না- রাজধানীর হালচাল দেখে তাদের কারো পক্ষেই করোনা পরিস্থিতির সঠিক কোনো ধারনা করা সম্ভব নয়।
রাজধানীর রাস্তা-ঘাট, যানবাহন, অফিস-আদালত, দোকান-পাট, শপিংমলের চিত্র দেখে খুব একটা বুঝবার ওপায় নেই যে, দেশ একটা মহামারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র কিছু মানুষের মুখে মাস্কটাই জানান দিচ্ছে- দেশে করোনা আছে।
তবে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিন এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বলছে দেশে করোনা বেশ ভালোভাবেই আছে- তা মানুষজন পাত্তা দিক আর না দিক।
গত বছরের মাঝামাঝিতে ডেল্টা ছোবলে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল করোনা পরিস্থিতি। ২৭ জুন থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত টানা দুই মাস দৈনিক মৃত্যু ছিল শতাধিক। ওই সময়ে দৈনিক সংক্রমণ ১০ হাজার ছাড়িয়েছিল। এর মধ্যে দিন তিরিশেক রোজ মারা যায় দুশোর বেশি। সে সময় বড় মৃত্যু সংখ্যা মানুষকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। মানুষ কিছুটা হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনেছে।
টিকা কর্মসূচি জোরদার হওয়ায় অক্টোবর থেকে করোনা প্রকোপ কমে আসে। জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনা একপ্রকার নিয়ন্ত্রণে থাকে। মৃত্যু এক অংকে নেমে আসে এবং এমনকি কয়েকদিন করোনায় কোনো মৃত্যু হয়নি দেশে। আর ডিসেম্বরের প্রথম দিকে শনাক্ত হারও নেমে এসেছিল ১ শতাংশের নিচে।
কিন্তু করোনার অতিসংক্রামক ধরন অমিক্রণের ছোবল জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে আবার বাড়তে থাকে সংক্রমণ এবং মৃত্যু। ১৩ জানুয়ারি শনাক্ত ৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এক সপ্তাহ না যেতেই ২০ জানুয়ারি শনাক্ত ছাড়িয়ে যায় ১০ হাজার। ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১২ দিন দৈনিক শনাক্ত ছিল ১০ হাজারেরর ওপরে। শনাক্ত হার চলে যায় ৩০ শতাংশের ওপরে। অর্থাৎ পরীক্ষায় প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জনের করোনা শনাক্ত হয়।
শনাক্ত বাড়ার কারণে তৃতীয় সপ্তাহে এসে মৃত্যুও বেড়ে যায়। ৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৩৬ জন মারা যায়। এ নিয়ে টানা ৭ দিন মৃত্যু রয়েছে ৩০-এর ওপরে। শনাক্ত হার কিছুটা কমে ২৩ দশমিক ৮৩ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু সংক্রমণ বাড়ার তৃতীয় সপ্তাহে গিয়ে মৃত্যু বাড়ে- তাই আগামী দিনগুলোতে মৃত্যু আরও বেড়ে যাবে।
ডিসেম্বরে সঙ্গে জানুয়ারি মাসের তুলনা করলে করোনার ভয়াবহতার চিত্রটি আরো পরিষ্কার হবে। ডিসেম্বর মাসে যেখানে ৯ হাজার ২৫৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন, সেখানে জানুয়ারি মাসে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ লাখ ১৩ হাজার ২৯৪ জন- অর্থাৎ এক মাসে রোগী বেড়েছে ২৩ গুণ। ডিসেম্বরে ৯২ জনের মৃত্যুর বিপরীতে জানুয়ারিতে মারা গেছেন ৩২২ জন- অর্থাৎ মৃত্যু বেড়েছে ৪ গুণের বেশি।
দেশে করোনা শুরুর পর থেকে এ যাবৎ সবচেয়ে বেশি সোয়া দু’লাখের মতো করোনা রোগী এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তাহলে-এমন একটা কঠিন অবস্থাতেও এবার মানুষ কেন করোনাকে একেবারেই আমল দিচ্ছে না?
এর একটি প্রধান কারণ করোনার নতুন ধরন অমিক্রনের মারণক্ষমতা কম। অতিমাত্রায় সংক্রমণ ক্ষমতা থাকলেও ডেল্টার তুলনায় এটি কম প্রাণঘাতি। গত জুনে ডেল্টা সংক্রমণকালে দৈনিক শনাক্ত ১০ হাজার ছাড়ালে মৃত্যু ছাড়িয়েছিল দৈনিক দুশো জন। কিন্তু এবার অমিক্রনে সংক্রমণ ১০ হাজার ছাড়ালেও মৃত্যু হচ্ছ প্রায় ৭ গুণ কম ৩০ জনের মতো।
আর একটি বিষয়- ডেল্টার তুলনায় অমিক্রনে জটিলতাও কম। আক্রান্তদের মধ্যে ৯৯ শতাংশকেই এবার হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না- বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন।
অমিক্রন ডেল্টার মতো প্রাণঘাতি না হলেও একে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ডেল্টায় সাধারণত বেশি বয়সীরা আক্রান্ত হলেও অমিক্রনে কিন্তু শিশুসহ সব বয়সেরর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ডিসেম্বরে যেখানে ৫৩৭টি শিশু করোনা আক্রান্ত হয়, সেখানে জানুয়ারির ২৯ দিনে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি শিশু। জানুয়ারিতে ১১ বছরের নিচে ২ জন এবং ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ৭ জনসহ মোট ৯ জন মারা গেছেন করোনায়। শুধু শিশু হাসপাতালেই এ যাবত মারা গেছে ৪৭টি শিশু। বোঝা যাচ্ছে শিশু-কিশোরদের জন্য অমিক্রন প্রাণঘাতি হয়ে উঠতে পারে।
কাজেই অমিক্রনকে আমরা যতটা নখদন্তহীন ভেবে নিশ্চিন্ত থাকছি ততটা নিশ্চিত থাকাটা সমীচীন নয়। মৃত্যু সংখ্যা কম হলেও সে কমের মধ্যে আপনি বা আমি পড়েওতো যেতে পারি। তাই সাধু সাবধান!
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টুডিও, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।