কোভিড মহামারীর মধ্যে বিদেশে পড়াশোনা
2022-02-06 23:59:46

বন্ধুরা, নতুন বছর এসেছে। আর কয়েক মাস পর আরও অনেক শিক্ষার্থী স্নাতক হবে। এসময়, বিশেষ করে বিদেশে অবস্থানরত চীনা শিক্ষার্থীরা কমবেশি অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবে। তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী পাশ্চাত্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবে। তবে স্বদেশে ফিরে আসার পর তাদের কেউ কেউ কর্মসংস্থানসংশ্লিষ্ট অনিশ্চয়তায় পড়বে। ২০২০ সাল থেকে কোভিড-১৯ মহামারী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এখন টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং অনেকে টিকা গ্রহণ করেছেন, তবে এ মহামারী কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা মহামারীর প্রেক্ষাপটে বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন চীনা শিক্ষার্থীর গল্প তুলে ধরবো।

শিক্ষার্থী লিউ ই খুন দুই মাস পর ব্রিটেনের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি পাবে। বর্তমানে সে চীনের শাংহাই শহরের একটি কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করছে। পাশাপাশি, সে অন্যান্য কোম্পানিতে নিজের সিভি পাঠিয়েছে। ২০২১ সালের শেষ মাসের শেষ সপ্তাহে টানা ৬টি সাক্ষাত্কারেও অংশ নিয়েছে সে। সেসব সাক্ষাত্কারের ফলের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

বিদেশ থেকে স্নাতক হওয়া চীনা শিক্ষার্থীদেরকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কী কী সমস্যায় পড়তে হয়? চীনা সমাজে এখন কোন কোন বিষয়ে বিদেশি ডিগ্রিধারীর কদর বেশি? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন সংবাদদাতারা।

২০১৭ সালে লিউ ই খুন ব্রিটেনে গিয়ে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শুরু করে। ৪ বছর পর সে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে ভর্তি হয়ে মাস্টার্স পর্যায়ের লেখাপড়া শুরু করে। তার মেজর অর্থনীতি। টানা এক বছর সে লাইব্রেরিতে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেছে। তার স্নাতক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাঙ্কিং সারা বিশ্বের কিউএস তালিকায় ৪৪০ নম্বরে। তবে মাস্টার্স বিশ্ববিদ্যায়ের রাঙ্কিং ৩৫ নম্বরে। শিক্ষার্থী লিউ বলে, বিদেশের পড়াশোনা কল্পনার চেয়ে কঠিন। দিনরাত পড়াশোনা করতে হয়।  

স্নাতক হওয়ার পর চীনে ফিরে আসা তার অনেক আগের পরিকল্পনা ছিল। আসলে বিদেশে পড়াশোনা কেবল ভিন্ন সংস্কৃতি উপভোগ করার এক অভিজ্ঞতা। যদিও অর্থনীতি মেজর বহু বছর ধরে জনপ্রিয়; মাস্টার্স ডিগ্রির যোগ্যতাপত্রও বেশ ভালো, তবে কয়েক দফার সাক্ষাত্কার দিয়েও নিজের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারছে না সে।

চীনের একটি বেসরকারি জরিপ প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত ‘বিদেশে চীনা শিক্ষার্থীদের শ্বেতপত্র, ২০২১’ থেকে জানা গেছে, চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কার্যকরভাবে মহামারী নিয়ন্ত্রণের কারণে, গত বছর বিদেশে অধ্যয়নরত চীনা শিক্ষার্থীরা স্বদেশে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে অতিরিক্ত আশাবাদী হয়ে ওঠে এবং স্নাতক হওয়ার পর তাদের ৩১ শতাংশ দ্রুত দেশে ফিরে আসে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি।

পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, বিদেশে অধ্যয়নকারী চীনা শিক্ষার্থীরা নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। এটা একটা সমস্যা। আবার সংশ্লিষ্ট কাজে তাদের অভিজ্ঞতার অভাবও একটি সমস্যা। গত ৩ বছরে এই দুটি বিষয় বিদেশে অধ্যয়নকারী অনেক চীনা শিক্ষার্থীকে ভুগিয়েছে।

চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিদেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। চীনা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নতুন কর্মীর ইন্টার্নশিপ অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব দেয়। আর বিদেশি কোম্পানিগুলো ‘সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানের দক্ষতার’ ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়।

চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত শিক্ষার্থীদের কাজ ও ইন্টারর্নশিপ অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব দেয়। তারা ইন্টারর্নশিপ অভিজ্ঞতা থেকে কর্মীর দক্ষতা বিবেচনা করার চেষ্টা করে। বিদেশি কোম্পানিগুলো ব্যক্তিগত চরিত্রসহ বিভিন্ন ‘সফট  বিষয়’-এর ওপর গুরুত্ব দেয়। তা ছাড়া, বিদেশি কোম্পানিগুলো নতুন কর্মীদের চরিত্র অনুসারে একটি প্রতিবেদন রচনা করে, যাতে তাদের উপযোগী কাজে তাদের নিয়োগ করা যায়। যেমন, যারা বহির্মুখী স্বভাবের, তাদের বিক্রয় বিভাগে কাজে লাগানো হয়।

শিক্ষার্থী লিউ শুধু স্নাতক ডিগ্রিটুকুই অর্জন করেছে। তার ইন্টার্নের অভিজ্ঞতাও নেই। তাই এখনও তার কোনো কর্মসংস্থান হয়নি। অনেকের ধারণা, বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর চীনে ফিরে আসলে সহজে সেরা চাকরি পাওয়া যায়। মাসিক বেতনও বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু আসল অবস্থা ভিন্ন। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পরও আজকাল চীনে সাধারণ চাকরি করছেন অনেক শিক্ষার্থী। অনেকে শিক্ষকতা বা সরকারি চাকরির মতো কাজ খুঁজে পেলেই খুশি। ২০২০ সালের জরিপ অনুসারে,  যারা স্নাতক হওয়ার পর বিদেশ থেকে চীনে ফিরে এসেছে, তাদের মধ্যে ২১ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছে এবং ২৫ শতাংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে।

যারা বিদেশে পড়াশোনা করেছে, তাদের মাসিক বেতনও চীনের স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের তুলনায় তেমন একটা বেশি নয়। এ সম্পর্কে চীন-ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যক্তি ওয়াং চি ছি বলেন, ব্রিটেনে পড়াশোনা করে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য বার্ষিক ব্যয় প্রায় ২ লাখ ইউয়ান, জীবনযাপনের খরচ ১.২ লাখ ইউয়ান, তাই সারা বছরের খরচ ৪ লাখ ইউয়ান। দুই বছরে তা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৮ লাখ ইউয়ানে।

স্নাতক হওয়ার পর চীনের চারটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মের একজন জুনিয়র কর্মীর বার্ষিক আয় প্রায় ১.২ লাখ ইউয়ান। এই চাকরি তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো বলতে হবে।

২০২১ সালে চীনের হুয়াতুং নোর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ থেকে জানা গেছে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সময় যত বেশি, চাকরিতে বেতন তত বেশি। তবে, ২০১৯ সালে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী ও বিদেশে পড়াশোনা করা চীনা শিক্ষার্থীদের বেতনের তুলনা করলে দেখা যাবে, তাদের মধ্যে বেতনের পার্থক্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এ সম্পর্কে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শেন ওয়ে ছিন বলেন, কেবল আর্থিক দিক বিবেচনা করলে, বিদেশে পড়াশোনা করে কোনো লাভ নেই। তবে শিক্ষার্থীদের বিদেশের পড়াশোনা তাদের চরিত্র ও দক্ষতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা টাকা দিয়ে বিচার করা যায় না।

বেতন ক্রমশ বাড়ে; কাজের অভিজ্ঞতা যত বাড়ে, বেতনও তত বাড়ে। এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক উচ্চবিদ্যালয়ের কর্মী ছেন ইউয়ান বলেন, “আমাদের স্কুল অনেক কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এসব কর্মী বিদেশে পড়াশোনা করেছেন।” আসলে স্নাতক ডিগ্রির ওপর কাজের দক্ষতা তেমন একটা নির্ভর করে না; সেটা নিজের প্রচেষ্টায় অর্জন করতে হয়।

আরেকটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, আর তা হল, বিদেশ থেকে ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেতনের পাথর্ক্য খুবই কম। যারা বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ পায়, তারা অধিকাংশই চীনের বড় শহরের, তাই কর্মসংস্থানের সুযোগও মহানগরে থাকে, এমন জায়গায় প্রতিযোগিতা তুমুল।

বিদেশ থেকে ফিরে আসা চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ‘কর্মসংস্থানের জেট ল্যাগ’। তার মানে, অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান শুধু সেই বছরের নতুন স্নাতক শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেয়। যদি সময়মতো উপযোগী কর্মসংস্থানের সুযোগ না-পাওয়া যায়, তাহলে সেরা চাকরি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক হ্রাস পায়।

চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালে বিদেশে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি ছিল। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ১৯ হাজারেরও বেশি স্নাতক হওয়ার পর চীনে ফিরে এসেছে। এ সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীল প্রায় ৭৮ শতাংশ, যা ২০১০ সালের ৫০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।

২০১৯ সালে বিদেশে পড়াশোনা করা চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ লাখেরও বেশি ছিল, যা নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। এ সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সাথে একটি প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিকভাবেই: চীনের সমাজে কী ধরনের বিদেশি ডিগ্রি দরকার? শুয়ে মেং মার্কিন ডিজাইন একাডেমি থেকে স্নাতক হয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৩ বছর চাকরিও করেছেন। তিনি মহামারীর কারণে চীনে ফিরতে চান এবং অনলাইনে নিয়োগের মাধ্যমে শাংহাইয়ের একটি কোম্পানিতে যোগ দেন। যখন সিভি পাঠান, তখন মার্কিন শহরের ডিজাইন প্রকল্প ও পেশাগত বই অনুবাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি অনলাইন সাক্ষাত্কারের ৩ দিন পর চাকরির অফার পান।

চাকরি শুয়ে’র জন্য কেবল বেতন অর্জন নয়, বরং কর্মদক্ষতা অর্জনের মাধ্যম। শাংহাইয়ের কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি দক্ষিণ চীনের সৈকত এলাকার দর্শনীয় স্থানের ডিজাইন কাজে অংশ নেন। নিজের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমার কোম্পানির পরিবেশ ভালো। অফিসে সময়ও শিথিল। কোম্পানি কর্মীদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়।”

সম্প্রতি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, অনলাইন পরিষেবা উন্নত করে বিদেশ থেকে চীনা শিক্ষার্থীদের ফিরে আসা বা নিজেদের ব্যবসা চালু করার ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া হবে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শেন বলেন, চীন ও ব্রিটেনের মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষাদান তুলনা করলে, বিদেশে পড়াশোনার তেমন কোনো আলাদা সুবিধা নেই। কারণ, ব্রিটেনে মাস্টার্স ডিগ্রী একবছর মেয়াদের; কোনো থিসিস লাগে না। তবে চীনের মাস্টার্স শিক্ষা ৩ বছরের।

ছাত্রছাত্রীদের পিতামাতা ও শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিতে চীনের গুণগত মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কঠিন। সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া অনেক চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। তাই, এ পরিস্থিতিতে যাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা বিদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিতে আগ্রহী হয়।

মোদ্দাকথা, বিদেশে পড়াশোনা করা শুধু কর্মজীবনের প্রথম পদক্ষেপ। দক্ষতা অর্জনের জন্য চর্চা প্রয়োজন। সেটি শিক্ষার্থীদের নিজেদের প্রচেষ্টার সাথে সম্পর্কিত। নতুন চিন্তাভাবনাসহ সৃজনশীলতার পরিচয় দেওয়া যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)