সম্প্রতি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, দেশে ধাপে ধাপে কারিগরি শিক্ষার্থীদের ‘কাওখাও’ পরীক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-পরীক্ষার আওতায় আনা হবে। এটা নিঃসন্দেহে চীনের লক্ষ লক্ষ কারিগরি শিক্ষার্থীর জন্য একটি ভালো খবর।
পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে চীনের কারিগরি স্কুলের সংখ্যা ৯৮৬৫টি এবং কারিগরি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৬২ লাখ ৮১ হাজার ৪০০ জন। প্রতিবছর চীনের মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের একটা অংশ কোনো-না-কোনো কারিগরি স্কুলে পড়ে বা তাদের তা পড়তে হয়। নবম গ্রেডের পরই তাদেরকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এদিকে, কারিগরি স্কুলের শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জনশেষে সরাসরি কাজে যোগ দেয় বলে তাদের বয়স থাকে তুলনামূলকভাবে কম (কারণ, তারা অন্যান্য শিক্ষার্থীর তুলনায় তিন বছর কম পড়াশোনা করে)। ফলে, তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের চাইতে কম মর্যাদাসম্পন্ন মনে করা হয়ে আসছে। কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এর লক্ষ্য কি শুধু দক্ষতা অর্জন হওয়া উচিত? নাকি, এ ধরনের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার্থীর মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা দরকার? বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। চীনের হুয়াতুং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের পরিচালক স্যু কুও ছিং বলেন, অতীতে চীনে কারিগরি স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা সাধারণ কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা করতে পারত না। তাই, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা কারিগরি শিক্ষার প্রতি তেমন একটা আকৃষ্ট হতো না।
২০১২ সাল থেকে চীনের শানতুং প্রদেশসহ কয়েকটি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ‘বসন্তকালীন কাওখাও’ পরীক্ষা চালু করা হয়। এ পরীক্ষা ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপ কমানোর জন্য চালু করা হয়। কিন্তু, এ ধরনের পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ সারা চীনে নেওয়া হয়নি।
বসন্তকালীন কাওখাওয়ের তুলনায় কারিগরি কাওখাও আরও উন্মুক্ত। সকল উচ্চ বিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী আর কারিগরি স্কুলের শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। সমান যোগ্যতাপত্র আছে—এমন অবসরপ্রাপ্ত সৈন্য বা বেকার কর্মীরাও এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। পরীক্ষার বিষয় ও জটিলতার প্রশ্নেও কারিগরি কাওখাও ও সাধারণ উচ্চ বিদ্যালয়ের কাওখাওয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সাধারণ কাওখাও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা মনে রেখে করা হয়। যারা ক্লাসের পড়াশোনায় ভালো নয়, তাদের জন্য এটি অনেক কঠিন পরীক্ষা। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে চীনের বিভিন্ন প্রদেশের কারিগরি কাওখাওয়ের পাসিং স্কোর ছিল ২০০ থেকে ৪০০, যা সাধারণ কাওখাওয়ের চেয়ে অনেক কম। তাই সেটি সাধারণ কাওখাওয়ের বাইরে আরেকটি নতুন ধরনের ‘ট্র্যাক’ বলা যায়।
চীনের কারিগরি স্কুলে ভর্তি-পরীক্ষায় কোন কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়? আসলে, চীনের বিভিন্ন স্থানের প্রশ্নপত্রের মধ্যে পার্থক্য আছে। সারা দেশে একই পরীক্ষা-পদ্ধতি চালু হয়নি। হুপেই প্রদেশে যেখানে কারিগরি দক্ষতার পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেখানে কুয়াংতুং প্রদেশে ‘৩ প্লাস যোগ্যতাপত্র’ পরীক্ষা নেওয়া হয়। চীনের মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিগরি প্রশিক্ষণ স্কুলের মেজরগুলোর তালিকা অনুসারে বর্তমানে চীনে মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিগরি প্রশিক্ষণের মেজরের সংখ্যা ৩৫৮টি। প্রতিটি মেজরে নিজ নিজ প্রশিক্ষণ কোর্স, মূল ক্লাস, ইলেকটিভ ক্লাস রয়েছে। প্রতিবছর প্রতিটি মেজরের জন্য আলাদা প্রশ্নপত্র রচনা করা অসম্ভব। তাই, কারিগরি কাওখাও পরীক্ষায় আলাদা আলাদা মেজরের কথা বিবেচনা করা হয় না, বরং সাধারণভাবে কয়েকটি মেজর বেছে নিয়ে প্রশ্নপত্র রচনা করা হয়। সাধারণ কাওখাও পরীক্ষায় গণিত, ইংরেজি ও চীনা ভাষার ওপর প্রশ্ন থাকে। কারিগরি কাওখাওয়ের প্রশ্নপত্রেও এমন কমন বিষয় থাকে।
কারিগরি স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাওখাও সম্পর্কে চীনের শাআনসি নোর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছি চান ইয়ুং বলেন, বর্তমানে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এ কাওখাওয়ের প্রশ্নপত্র ভিন্ন। তবে, সাধারণত ‘১ প্লাস ২’ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। তার মানে মূল মেজরের মৌলিক বিষয় এবং কারিগরি’র দুটি প্রধান কোর্স থেকে প্রশ্ন করা হয়। পাশাপাশি, চীনা ভাষা, গণিত, বিদেশি ভাষার ওপরও প্রশ্নপত্র থাকে বা থাকতে পারে।
২০২২ সালে চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের কারিগরি শিক্ষার্থীদের কাওখাও গত ৬ জানুয়ারি শেষ হয়। শিক্ষার্থীরা ‘৩ প্লাস যোগ্যতাপত্র’ পদ্ধতিতে পরীক্ষায় অংশ নেয়। তারা চীনা ভাষা, গণিত, ও ইংরেজি ভাষার ওপর মূলত পরীক্ষা দেয়। তাদের কারিগরি যোগ্যতার পরীক্ষা গত বছর সম্পন্ন হয়েছে।
চীনের হুপেই প্রদেশের কারিগরি কাওখাও পরীক্ষায় এ, বি, সি, ডি, ও ই—এই পাঁচটি গ্রেড রয়েছে। যারা মেশিন বিদ্যুত্সংশ্লিষ্ট বিভাগে পড়তে আগ্রহী, তাদের জন্য ফিটার, টার্নার ও মিলার—এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে যে-কোনো একটি বেছে নিতে হয়। যারা কারিগরি পরীক্ষায় ডি গ্রেড পর্যন্ত পাবে, তারা পরের বছরের লিখিত কাওখাও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে।
উহান কারিগরি কলেজের শিক্ষক লি হং ছু বলেন, তাদের স্কুল হুপেই প্রদেশের কম্পিউটার, স্থাপত্য ও পর্যটন বিষয়ক পরীক্ষা আয়োজন করে থাকে। এখানে বিষয়সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন থাকে। যেমন, পর্যটন মেজরের ট্যুরিস্ট গাইড ও হোটেল প্রশাসন বিভাগে যারা পড়তে চায় তাদের পরীক্ষায় দর্শনীয় স্থানের বিস্তারিত পরিচয় ও নিজেদের গান গাওয়া বা নৃত্যের দক্ষতা যাচাই করা হয়। হোটেল প্রশাসনে রুম সার্ভিস, চীনা ও পাশ্চাত্য স্টাইলের খাবারের আদবসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
একজন শিক্ষার্থী হোটেল প্রশাসন কারিগরি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। নিজের পরীক্ষার বিষয় সম্পর্কে সে বলল, চীনা খাবারের সেট ৫ মিনিটের মধ্যে টেবিলের ঠিক জায়গায় সাজাতে হয়। প্লেট, বাটি, চপস্টিক ও গ্লাসসহ বিভিন্ন জিনিস রাখতে হয় দ্রুত। সাথে সাথে গ্লাসের মধ্যে রুমালও ভাঁজ করে রাখতে হয়।
বর্তমানে চীনের কারিগরি কাওখাও পরীক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কারিগরি দক্ষতার পরীক্ষা নেওয়া। সেটি পরীক্ষার ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতার সাথে জড়িত। এ পরীক্ষার আয়োজক স্কুলের প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষক লি বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীরা হুপেই প্রদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসে। তাদের পরীক্ষা শেষ করতে কমপক্ষে ২ দিন লাগে। কারিগরি পরীক্ষায় অনেক ধাপ রয়েছে। পরীক্ষার বিভিন্ন সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতিও আগে ঠিক করে রাখতে হয়। তাই এমন পরীক্ষার আয়োজন সহজ ব্যাপার নয়।”
চীনের শানতুং প্রদেশের লোকসংখ্যা বেশি। স্থানীয় কারিগরি কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ২০২২ সালে শাংতুংতে কারিগরি শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার ছিল। কারিগরি কাওখাও কলেজে ভর্তির সংখ্যাও ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার্থীদের কাওখাও পরীক্ষার গুণগত মান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ও তাদের বাবা-মা কারিগরি কাওখাও-এর প্রতি আকৃষ্ট হবে কি না, তা তাদের ওপরই নির্ভর করে। কারিগরি শিক্ষার আকর্ষণক্ষমতা এক্ষেত্রে জরুরি বিষয়।
২০২১ সালে উহান কারিগরি কলেজের ১২৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯৮ শতাংশেরও বেশি স্নাতক হবার পর চাকরি পেয়েছে। তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে ৩৩৯ জন। এ বছর আগের কয়েক বছরের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী কারিগরি কাওখাওতে অংশ নিয়েছে। কারিগরি কাওখাওয়ে উত্তীর্ণ হবার পর শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতার টেনশান দূর হয় না। তাদের সন্তানরা উপযোগী কাজ পাবে কি না, বেতন কেমন হবে, ইত্যাদি বিষয় তাদের মাথা ব্যথার কারণ। তাদের এসব টেনশান দূর করা গেলে চীনে কারিগরি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ও তাদের পিতা-মাতার আগ্রহ বাড়বে।
কারিগরি কাওখাও এবং সাধারণ কাওখাওয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট কারিগরি দক্ষতা অর্জন। এ সম্পর্কে বিভিন্ন কারিগরি স্কুলের শিক্ষকরা মনে করেন, কারিগরি প্রশিক্ষণের সাথে কর্মসংস্থানের বাস্তব চাহিদার সমন্বয় করা প্রয়োজন। পরীক্ষার ফলাফল বা স্কোর একমাত্র বিচার্য হওয়া উচিত নয়। শিক্ষার্থীদের অনুশীলন দক্ষতা, হ্যান্ড-অন ক্ষমতা সবই কারিগরি পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশে হতে হবে।
কারিগরি প্রশিক্ষণের উচ্চশিক্ষা ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার সংমিশ্রণ সহজ ব্যাপার নয়। আবার কাজটা একেবারে অসম্ভবও নয়। ছিংহুয়া ও পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় চীনের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দুটি। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ফলিত পদার্থবিদ্যার মতো মেজর রয়েছে। এর মানে, সাধারণ কাওখাও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা এ ধরনের ফলিত বিষয়ও মেজর হিসেবে গ্রহণ করে। প্রকারান্তরে তারা বিশ্ববিদ্যালয়েই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে! মোদ্দাকথা, জাতীয় পর্যায়েই সাধারণ উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি উচ্চশিক্ষার কাঠামো আরও স্পষ্ট এবং এ দুই শিক্ষার মধ্যে সমন্বয়সাধন করা প্রয়োজন। এভাবে দুই পথেই সেরা শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে।
(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)