নতুন যুগে প্রবেশ করেছে চীন-মধ্য এশিয়া সম্পর্ক
2022-01-31 12:00:07

 

গত ২৫ জানুয়ারি চীন মধ্য-এশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক ভিডিও শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে ‘চীন মধ্য-এশিয়ার পাঁচটি দেশের নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৩০তম বার্ষিকী-সংক্রান্ত যৌথ বিবৃতি’ গৃহীত ও প্রকাশিত হয়।

 

বিবৃতিতে বলা হয়: চীন ও মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করার কথা ঘোষণা করেছে সবপক্ষ। ছ’টি দেশ পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনা করার ভিত্তিতে সমৃদ্ধ, ফলপ্রসূ এবং দীর্ঘমেয়াদি মৈত্রীর কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে চীন-মধ্য এশিয়া অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 

চীন মধ্য-এশিয়া-বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শীর্ষ সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হচ্ছে চীন মধ্য-এশিয়া অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করে পারস্পরিক সম্পর্কের নতুন যুগ শুরু করার কথা ঘোষণা করা। ভবিষ্যতে চীন মধ্য-এশিয়ার মধ্যে সহযোগিতামূলক ফলাফল আরো সমৃদ্ধ হবে।

 

এবারের শীর্ষ সম্মেলন হলো চলতি বছর চীনের উদ্যোগে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক কার্যক্রম। পাশাপাশি, গত ৩০ বছরে মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রীয় প্রধানদের সঙ্গে চীনের প্রথম যৌথ সাক্ষাত্। এর অনেক তাত্পর্য রয়েছে।

 

শীর্ষসম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, গত ৩০ বছর চীন মধ্য-এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যা সমাধান, সুপ্রিতবেশীসুলভ বন্ধুপ্রতীম সহযোগিতা বাস্তবায়ন, এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক তৈরী করেছে। এ সময়ে পারস্পরিক রাজনৈতিক আস্থা ও সার্বিক সহযোগিতা অভূতপূর্ব উচ্চমানে পৌঁছেছে এবং নতুন ধরনের রাষ্ট্র-রাষ্ট্র সম্পর্কের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

 

চাইনিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের (সিএএসএস) রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া গবেষণালয়ের গবেষক সু ছাং মনে করেন, এবারে শীর্ষ সম্মেলন ছিল মধ্য-এশিয়ার পাঁচটি দেশের সঙ্গে চীনের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ। এর গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য রয়েছে। কারণ তাতে বিগত ৩০ বছরের দু’পক্ষের সহযোগিতামূলক ফলাফল পর্যালোচনা করা হয়। উভয়ের উপকার ও কল্যাণ সাধন করার ভিত্তিতে নতুন ধরনের রাষ্ট্র-রাষ্ট্র সম্পর্কের মতৈক্য এবং দু’পক্ষের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সহযোগিতা ও উন্নয়নের জন্য নতুন ব্যবস্থাপনা উত্থাপন করার পাশাপাশি নতুন চালিকাশক্তি বাড়িয়েছে এই সম্মেলন।

 

শীর্ষসম্মেলনে সবপক্ষ ভবিষ্যতমুখী হয়ে পারস্পরিক সম্মান, সুপ্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব, একসাথে একই নৌকায়, এবং উভয়ের উপকার ও পারস্পরিক কল্যাণ সাধন—এই “চারটি মৌলিক নীতি” অনুযায়ী, পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে, সহযোগিতা সম্প্রসারণ করতে, ভালো প্রতিবেশী, ভালো বন্ধু, ভালো অংশীদার ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করতে তাদের সম্পর্ক ধারাবাহিক ও স্থিতিশীলভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে একমত হয়েছে।

 

বিগত ৩০ বছরে চীন ও মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক পরিমাণ শতাধিক গুণ বেড়েছে। সেই পাঁচটি দেশে চীনের সরাসরি বিনিয়োগ ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।

 

এ পর্যন্ত মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে মোট ২৫ হাজারের বেশি চীন-ইউরোপ ট্রেন চলাচল করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন তথা চীন-মধ্য এশিয়া প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনটি ৩৮০ বিলিয়ন বর্গমিটার এলাকা অতিক্রম করেছে। মোট ৫০ কোটি মানুষ তা থেকে লাভবান হয়েছে। চীন-কাজাখস্তান অপরিশোধিত তেল পাইপলাইন হলো স্থল পথে চীনের অপরিশোধিত তেল আমদানির প্রথম আন্তঃসীমান্ত   যোগাযোগের ধমনী, তার মাধ্যমে চীন ১৫ কোটি টন তেল আমদানি করেছে। চীন-কিরগিজস্তান-উজবেকিস্তান রাজপথ ও চীন-তাজিকিস্তান রাজপথসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়িত হয়েছে। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের সঙ্গে চীন মোট ৫৮ জোড়া মৈত্রী শহর প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার লোক যাতায়াত করছে। “এক অঞ্চল এক পথ”  মধ্য এশীয় অঞ্চলে ফুল ফোটে এখন ফল দিচ্ছে।

 

শীর্ষসম্মেলনে বিভিন্ন পক্ষ যৌথভাবে “এক অঞ্চল এক পথ” উদ্যোগ মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে উত্পাদন দক্ষতা, জ্বালানী, কৃষি, আন্তঃযোগাযোগ, ডিজিটাল অর্থনীতি, দারিদ্র্যবিমোচন ও স্থানীয়সহ বিভিন্ন সহযোগিতা জোরদার করে, সক্রিয়ভাবে “এক অঞ্চল এক পথ” অংশীদারি সম্পর্কের সবুজ উন্নয়ন কার্যকর করে, ডিজিটাল সিল্ক রোড ও সবুজ সিল্ক রোড তৈরী করা যায়।

 

২০৩০ সাল পর্যন্ত চীন মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে তার বাণিজ্যিক পরিমাণ ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি পরবর্তী ৩ বছরে সেসব দেশকে ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের অনুদান প্রদান এবং ৫ হাজারটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা  ও সেমিনার আয়োজনের কথা ঘোষণা করেছে।

 

চীনের আন্তর্জাতিক-বিষয়ক গবেষণালয়ের গবেষক, শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার গবেষণা কেন্দ্রের মহাসচিব তেং হাও মনে করেন, চীনের বাজার, অর্থ ও প্রযুক্তিতে মধ্য এশীয় দেশগুলোর জন্য অনেক আকর্ষণীয় শক্তি আছে। ভবিষ্যতে মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বড় প্রকল্প কার্যকর করার ভিত্তিতে অব্যাহতভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও ডিজিটাল অর্থনীতিসহ বিভিন্ন নতুন বাণিজ্যিক কার্যক্রম সহযোগিতা সম্প্রসারণ করা যাবে, যাতে আঞ্চলিক উচ্চমানের উন্নয়ন সহযোগিতা বেল্ট তৈরি করে অঞ্চলটির অভিন্ন উন্নয়নের জন্য নিরন্তর চালিকাশক্তি যোগানো যায়।

 

বর্তমানে শত বছরের পরিবর্তন এবং শতাব্দীর মহামারীর প্রভাবে বিশ্ব কাঠামো গভীরভাবে সমন্বয় করা হয়েছে, আর আঞ্চলিক পরিস্থিতিরও জটিল পরিবর্তন হচ্ছে।

 

সু ছাং মনে করেন, ভবিষ্যতে মধ্য এশীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতা হবে। বিশেষ করে “যৌগিক” নিরাপত্তা সমস্যা আরো স্পষ্ট ও জটিল, নিরাপত্তা সমস্যা রাজনৈতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও প্রশাসন স্থিতিশীলতার ওপর হুমকি ডেকে আনবে।

 

তিনি বলেন, বিভিন্ন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের সামনে অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের ভাগ্য একই, সেজন্য ঐক্য ও সমন্বয় জোরদার করে, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতা ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ করতে হবে। যাতে কার্যকরভাবে বাহিক্য হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করে, আঞ্চলিক অভিন্ন সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে চীন-মধ্য এশিয়া অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি সুসংহত করা যাবে।

 

মহামারী ডেকে আনা গণ-স্বাস্থ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বিভিন্ন পক্ষ একমত হয়েছে যে, অধিকতরভাবে মহামারী প্রতিরোধ বাড়াতে, আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সা সহযোগিতা করে, ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু’র সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় করে, স্বাস্থ্যের সিল্ক রোড এবং বিশ্ব গণ-স্বাস্থ্য নিরাপত্তা রক্ষা করার চেষ্টা চালাবে। চীন ২০২২ সালে মধ্য এশীয় দেশগুলোকে ৫ কোটি কোভিড-১৯ টিকা প্রদান করে বিভিন্ন দেশে পরিকল্পিত নিরাপত্তা বাধা তৈরি করতে সহায়তা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে।

 

সু ছাং আরো বলেন, একটি সাধারণ ভবিষ্যত শেয়ার করা এবং সহযোগিতা ও কল্যাণের চেতনায়  চীন মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে মৈত্রী বজায় রেখে সহযোগিতা ত্বরান্বিত হবে এবং মানবজাতির অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি প্রতিষ্ঠার নতুন অধ্যায় রচিত হবে।

 

(প্রেমা/এনাম)