কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বকে বিশৃঙ্খল করে ফেলেছে। বিশ্ব অর্থনীতি ও বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে এবং গত দুই বছরে বিশ্ব পরিস্থিতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। মহামারী সংক্রমণের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে এর তীব্রতা বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং উন্নয়ন বৈষম্য তীব্র হয়ে উঠছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো জিরোসাম গেম নিয়ে ব্যস্ত। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর একতার অভাব বা সিদ্ধান্তহীনতা আন্তর্জাতিক সমাজকে এক বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্বে স্থিতিশীল আচরণকারী রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে চীন। যা বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে।
এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে ৫৬ লাখ ৫৯ হাজার মানুষ মারা গেছে। পাশাপাশি দুনিয়াজুড়ে ৩৬ কোটিরও বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। তবে বিশ্ব অর্থনীতি, বিশেষ করে- উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে মধ্য ও নিম্ন আয়ের এবং অন্যান্য দুর্বল দেশগুলো রয়েছে।
করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরণ বর্তমান পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে
ভাইরাসের ঘন ঘন প্রাদুর্ভাব, বিশেষ করে ডেল্টা ও ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট মহামারী প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নতুন আশঙ্কা তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- মহামারী আরও দীর্ঘ সময় ধরে চলবে। তাই, আমাদের আরও গুরুতর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
তবে, বাস্তবতা হলো- নভেল করোনাভাইরাসের চেয়েও আশঙ্কাজনক হচ্ছে ‘রাজনৈতিক ভাইরাস’, যা ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘ভাইরাসের রাজনীতিকরণের’ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। মহামারী একদিন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ‘রাজনৈতিক ভাইরাসের’ কারণে সৃষ্ট ফাটল ও বৈষম্য আগামী কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ভ্যাকসিনের বৈশ্বিক প্রয়োগ এবং বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। শুধুমাত্র চীন দেশে মহামারী রোধে ব্যাপকভাবে টিকা দিয়েছে। পাশপাশি বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ২ বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি, ৩০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে মহামারীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী লড়াই করেছে।
২০০৮ সালে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা আঘাত হানে। সেই আঘাত পুরোপুরি সামলে ওঠার আগেই মহামারীটি বিশ্বে আঘাত হানে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন আবারও আঘাতপ্রাপ্ত হলো। এতে উন্নত ও উদীয়মান দেশগুলির মধ্যে মেরুকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্প্রতি বলেছে যে ২০২২ সাল হবে একটি কঠিন বছর। সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছে যে- এ বছরটি হবে “একটি বন্ধুর পথ পারি দেওয়ার” মতো। বাণিজ্য ও উন্নয়ন-বিষয়ক জাতিসংঘের সম্মেলন গত সেপ্টেম্বর বলেছিল যে- ২০২৫ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষতির পরিমাণ হবে ১২ ট্রিলিয়ন ডলার।
প্রকৃতপক্ষে, মহামারীটি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইন ও গণ-যাতায়াত ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। শক্তি ও খাদ্যের ঘাটতি বেড়েছে এবং অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। আরও খারাপ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর আর্থিক নীতির সামঞ্জস্যের সংকট সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এতে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশের মধ্যে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং মূলধনের বহিঃপ্রবাহ হতে পারে।
অন্যকথায়, উন্নয়নশীল দেশগুলি ২০২২ সালে আরও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। সুতরাং, মহামারী নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি, তাদের সামষ্টিক, সবুজ এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য সহায়ক সামষ্টিক আর্থিকনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
এই অবস্থায় চীন ‘গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ প্রস্তাব দিয়েছে, যা বিশ্বের আর্থিক পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখতে পারে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্র একে স্বাগত জানিয়েছে।
আশা করা হচ্ছিল, নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগের সরকারের নীতি থেকে সরের আসবেন। কিন্তু বাস্তবতা তেমন হয়নি। বরং বাইডেন প্রশাসন "আমেরিকা ইজ কামিং ব্যাক” ঘোষণা দিয়ে মূলত তার পূর্বসূরীর "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে। যা খুবই হতাশাজনক।
চীন এখন বিশ্ব পরিচালনায় অবদান রাখছে
এই অবস্থায়, চীন নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়ে বৃহৎ শক্তির মধ্যে সম্পর্কের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একটি কৌশল কাঠামো তৈরি করার প্রস্তাব করে, চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্থিতিশীল করার জন্য চেষ্টা করেছে। যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উভয়ের জয়ের নীতি।
বৈশ্বিক শাসন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। কারণ, বিশ্বে দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ডিজিটাল অর্থনীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবুজ শক্তি, বায়োমেডিসিন, সাইবার নিরাপত্তা ও মহাকাশ প্রযুক্তির মতো খাতে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়েছে।
যেহেতু বিদ্যমান বৈশ্বিক প্রশাসন উদীয়মান আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবিলা করতে পারছে না, তাই বহুপাক্ষিকতার উপর ভিত্তি করে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে কেন্দ্র করে সার্বিক সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি বা আরসিইপি, বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি যা গত পহেলা জানুয়ারী কার্যকর হয়েছে। এ অবস্থায় মুক্ত বাণিজ্য লভ্যাংশ প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২২ সাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে এবং চীনকে একটি মহান আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার দ্বিতীয় শতবর্ষের লক্ষ্য অর্জনের দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবে যা সমৃদ্ধ, শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত।
চীন এসময় বিশ্বব্যাপী শাসন ব্যবস্থার সংস্কারের প্রচার চালিয়ে যাবে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংস্কারের প্রস্তাব দেবে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, সবুজ উন্নয়নে নেতৃত্ব দেবে, জনস্বাস্থ্য উন্নত করবে, কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং ডিজিটাল গভর্নেন্স এবং সবুজ প্রশাসনের মতো উদীয়মান ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মোহাম্মদ তৌহিদ; সিএমজি বাংলা, বেইজিং।