চীনের সেতু নির্মাণকারী শিক্ষাবিদ কাও জুং ইয়ু’র গল্প
2022-01-24 18:15:01

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অবকাঠামো নির্মাণকাজ দ্রুত সামনে এগিয়েছে। দেশে-বিদেশে চীনের অবকাঠামো নির্মাণকাজের গুণগত মান ও গতি সুবিখ্যাত। বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজে সেতুর নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন ডিজাইন ও আকারের সেতু কেবল যাতায়াতে সুবিধা দেয় না, বরং নকশাকারের চিন্তাধারা ও চেতনার প্রতিফলনও ঘটায়।  আজকের আসরে আমরা চীনের একজন সেতু নির্মাণকারী শিক্ষাবিদের গল্প তুলে ধরবো, যার নাম কাও জুং ইয়ু। তিনি গত ৩৬ বছর ধরে চীনের ৫০টিরও বেশি সেতুর নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছেন। তাঁর মূল কাজ সেতুসংশ্লিষ্ট গবেষণা ও উদ্ভাবন। তাই বিভিন্ন সেতুর নির্মাণকাজে তাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়েছে। দ্রুতগতির ট্রেনের জন্য বড় স্প্যানের সেতু, ঝুলন্ত সেতু এবং জটিল প্রাকৃতিক পরিবেশে সামুদ্রিক সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করেছেন।


শিক্ষাবিদ কাও জুং ইয়ু ছোটবেলা থেকেই সেতু পছন্দ করতেন। ১৯৮১ সালে যখন তিনি কাওখাও পরীক্ষা দিয়ে সাউথওয়েস্ট পরিবহন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলপথ ও সেতু বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৮৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি চীনের রেলপথ ও সেতু ব্যুরোর প্রযুক্তি বিভাগে চাকরিতে যোগ দেন। দুই বছর পর তিনি চীনের রেলপথ ও সেতু অনুসন্ধান ও ডিজাইন একাডেমিতে সেতু’র ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। গত ৩৬ বছর তিনি প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে কাজ করে আসছেন। যে-কোনো ব্রুপ্রিন্টে সমস্যা থাকলে তা তিনি খুব কম সময়ের মধ্যে বের করে ফেলেন। তিনি বহুবার বলেছেন যে, বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার; এতে আরও বেশি চিন্তা-গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হয়। তবে প্রকৌশলীরা কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে পারবে না। কারণ, তাদের ব্যর্থতা নির্মাণকাজের নিরাপত্তা ও মানুষদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।

গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের শুরুতে শিক্ষাবিদ কাও ইয়ু জুং কেবল-স্থিত কাঠামো সফ্টওয়্যার ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন এবং এ ব্যবস্থা আগের চেয়ে আরও উন্নত ও ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৯৮ সালে চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের ফুচৌ শহরে মিনচিয়াং সেতু নির্মাণের সময় বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত কেবল-স্থিত কাঠামো সফ্টওয়্যার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সেই সময় ৩৪ বছর বয়সের শিক্ষাবিদ কাও তাঁর গবেষকদল নিয়ে এক বছর ধরে কম্পিউটারের সফ্টওয়্যার ডিজাইন করেন। ফলে সেতুর নির্মাণকাজে প্রায় ২০ শতাংশ ইস্পাত কম লাগে এবং নির্মাণের মোট খরচ ৩ কোটি ইউয়ানেরও বেশি হ্রাস পায়। ২০০১ সালে তাঁর নেতৃত্বে চীনের প্রথম সমুদ্রের ওপর সেতু--তুংহাই সেতুর ডিজাইন করা হয়। এটি নির্মাণে নতুন ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এতে সেতু নির্মাণের গতি অনেক বেড়ে যায়। তারপর চীনের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াংসি নদীর উপর তিনটি তিন টাওয়ারের ঝুলন্ত সেতুর ডিজাইন করেছেন তিনি। বিশ্বে একাধিক টাওয়ারের ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করেছে চীনই আগে।

এ সম্পর্কে শিক্ষাবিদ কাও বলেন, উদ্ভাবনের মূল উদ্দেশ্য অব্যাহতভাবে অগ্রগতি অর্জন করা। তাঁর প্রচেষ্টায় উহান শহরে ইয়াংসি নদীর উপরে রেলপথ ও সড়কপথের সমন্বয়ে নতুন সেতু নির্মিত হয়। এটি ছিল শিক্ষাবিদ কাওয়ের কর্মজীবনে একটি মাইলফলক।

২০০৯ সাল থেকে চীনের দ্রুতগতির ট্রেন অতুলনীয় গতিতে উন্নত হয়েছে। তখন থেকে চীনের দ্রুতগতি ট্রেনের জন্য বড় স্প্যানের সেতু নির্মাণের কাজে মনোযোগ দেন শিক্ষাবিদ কাও। সেতুর মোট দুই তলা রয়েছে। উপর তলায় গাড়ি চলবে এবং নিচ তলায় চলবে ট্রেন। এমন সেতুর কাঠামোগত ডিজাইন সাধারণ সড়কসেতুর চেয়ে অনেক কঠিন। যখন তিনি এমন সেতু ডিজাইনের প্রস্তাব দেন, তখন তা অনেকে মনে ব্যাপক সন্দেহ ও প্রশ্নের উদয় করেছিল। অনেক বিদেশি বিশেষজ্ঞও মনে করেছিলেন, এমনটা বিশ্বের কোনো দেশে করা হয়নি; এতে বিরাট ঝুঁকি রয়েছে। তবে শিক্ষাবিদ কাও তাঁর প্রস্তাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যান। তিনি গবেষকদলের সাথে বারবার পরীক্ষা, বিশ্লেষণ ও হিসাবের কাজ করেন। অবশেষে দুই তলার সেতু’র গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব পেশ করেন তিনি। তিনি এমন কাঠামো ডিজাইন করেন, যা তৈরিতে প্রায় ৩৩৩০ টন ইস্পাত সাশ্রয় হবে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের নির্মাণব্যয়ও ১১ কোটি ইউয়ান হ্রাস পায়।

কাও তাঁর কর্মজীবনের অধিকাংশ ব্যয় করেছেন শাংহাই থেকে চিয়াংসু প্রদেশ পর্যন্ত ইয়াংসি নদীর ওপর রেলপথ ও সড়কসেতু নির্মাণের কাজে। তিনি বিভিন্ন নেতিবাচক উপাদান মোকাবিলা করে, একটি নিরাপদ ও কম খরচের সেতু নির্মাণ করেন। এ সেতু নির্মাণের সময় প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার ওপরও নজর রাখা হয়েছে।

এ সম্পর্কে কাও জানান, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ আর নিম্ন কার্বন তার প্রকল্প-ডিজাইনে অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রেখে আসছে। ২০০৫ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট সেতু’র নির্মাণকাজ নিয়ে টানা ৫ বছর ধরে তারা গবেষণা করেছেন। কারণ, এ সেতু’র নির্মাণ ইয়াংসি নদীর উপর দিয়ে যাতায়াত নিশ্চিত করার পাশাপাশি, স্থানীয় ভূতত্ত্ব ও জলসেচসহ বিভিন্ন চাহিদার কথাও বিবেচনা করতে হয়েছে। ফলে সেতুর প্রধান অংশের উচ্চতা ১০৯২ মিটার উঁচু হয়। এর মানে সেতু’র ওজন অনেক বেড়ে যায়। এক হাজার মিটারের স্প্যানের সেতুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কয়েক দফায় উন্নত গবেষণা করেছেন তিনি। সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে ইস্পাতের ট্রাস বেছে নিয়েছেন তিনি এবং তারের ব্যবহার করেছে। এতে সেতুর ওজন কমে যায়।

২০২০ সালের পয়লা জানুয়ারি হুসুথং ইয়াংসি নদীর সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এই সেতুতে ট্রেন ও গাড়ি যাতায়াত করতে পারে। এ সেতু’র ডিজাইনের কাজ বিশ্ব বিখ্যাত জর্জ রিচার্ডসন পুরস্কার লাভ করে।

উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা সেতু নির্মাণের মূল তত্ত্ব। বর্তমানে চীনের নদী, সমুদ্র ও সমভূমিতে ভায়াডাক্ট নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভবিষ্যতে চীনের সেতু নির্মাণকাজ উপকূলীয় এলাকার দ্বীপ অঞ্চল বা পশ্চিম মালভূমির গিরিখাতে সম্প্রসারিত হবে, যা সেতু ডিজাইনারদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে সঙ্গে সেতু ব্যবহারের মেয়াদ, কাঠামো ও পরিবেশ সংরক্ষণের চাহিদা মেটাতে হবে তাদের।

বর্তমানে বয়স্ক শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি সবসময় যুব প্রকৌশলীদের জন্য সিনিয়র প্রকৌশলীদের গল্প শেয়ার করেন। তাদের সৃজনশীলতা, বাস্তব কর্মচেতনা আরও সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করেন তিনি। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)