বায়ুদূষণের কবলে পড়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান এখন দ্বিতীয়। পাশাপাশি ভারতের দিল্লি ও উত্তর মেসিডোনিয়ার স্কোপজ যথাক্রমে ২৪১ ও ১৯৫ একিউআই সূচক নিয়ে প্রথম ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এদিকে, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা আইকিউ-এয়ারের তালিকায় বিভিন্ন সময় পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরের দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে ছিল রাজধানী ঢাকা। বায়ুদূষণের কারণে কমছে মানুষের আয়ু, বেড়ে চলেছে নানা রকম স্বাস্থঝুঁকি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত দিলেও সাধারণ মানুষকেই সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হবে।
গত বুধবার সকাল ১০টায় ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ২৬৯ স্কোর রেকর্ড করা হয়। অর্থাৎ, জনবহুল এ শহরের বাতাসের মান 'অস্বাস্থ্যকর' পর্যায়ে উঠে গেছে। ওইদিন চীনের উহান ও ভারতের নয়াদিল্লি শহর যথাক্রমে ২৫২ ও ২১৪ একিউআই স্কোর নিয়ে তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দখল করে। করোনাভাইরাসের ছোবলে বিপর্যস্ত মানুষ বায়ুদূষণের কবলে আরও বেশি অসহায় ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন কাটাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বাতাসে ভেসে বেড়ায় ধুলা ও ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক উপাদান। ঢাকার প্রায় দুই কোটি মানুষ দূষিত বাতাসের মধ্যেই বসবাস করছেন। নির্মাণকাজের ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটা- প্রভৃতি কারণে দূষণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়া শহরের উন্নয়নমূলক কাজ চলতে থাকায় ঢাকার রাস্তাঘাট কাটতে হয়েছে। এতে ধুলাবালি পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক যৌথ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ঢাকার বায়ু দূষণের ৩টি প্রধান কারণ হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ স্থানের ধুলা-বালি।
বায়ুদূষণের ক্ষতি এড়াতে নানা সতর্কতামূলক পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, দূষণের কারণে শুধু ফুসফুসই নয়, ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে মানবদেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যে বলা হয়, বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসে দূষিত বাতাস গ্রহণ করে থাকে। তা ছাড়া, করোনারি ধমনি বন্ধের সঙ্গে বায়ুদূষণের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। করোনারি ধমনির মাধ্যমেই হৃৎপিণ্ডে রক্ত, অক্সিজেনসহ নানা পুষ্টি উপাদান সরবরাহ হয়। স্ট্রোকসহ মস্তিষ্কের নানা সমস্যার সঙ্গে সংযোগ রয়েছে বায়ুদূষণের। এমনকি মস্তিষ্কের কার্যকারিতার ওপর বায়ুদূষণ মারাত্মক আকারে প্রভাব ফেলতে পারে বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে। বাদ পড়ে না চোখও। চোখে শুষ্কতা, অস্বস্তি ও ব্যথা হয় এবং নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। বাতাসে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। প্রতিবছর ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে প্রায় ৫০ টন সীসা নির্গত হচ্ছে। শুষ্ক ঋতুতে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে বায়ুতে সীসার পরিমাণ সর্বোচ্চে পৌঁছে। শিশুদের রক্তে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি তাদের মস্তিষ্ক এবং বৃক্ককে নষ্ট করে ফেলতে পারে। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের তুলনায় শিশুরা সীসা দূষণে তিনগুণ বেশি আক্রান্ত হয়।
রাজধানী ঢাকায় শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। বায়ুদূষণের সূচকে ৩০১ থেকে ৫০০ হলে বা তার বেশি হলে বাতাসে দূষণের মান ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। এ সময় স্বাস্থ্য-সতর্কতা বজায় রাখা প্রত্যেক নগরবাসীর জন্য জরুরি।
প্রতিবেদনে জানা যায়, বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। ২০১৫ সালে বিভিন্ন প্রকার দূষণের শিকার হয়ে সারা বিশ্বে ৯০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছিল বাংলাদেশে। দূষণজনিত যত মৃত্যু ঘটে তার দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে প্রধানত বায়ুদূষণের কারণে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন এবং বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে।
মোহাম্মদ তৌহিদ; সিএমজি বাংলা।