২০২১ সালে চীনে শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটে ব্যাপক পরিবর্তন
2022-01-17 14:23:55

প্রতিটি শিশু যেন সমান ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা পেতে পারে—তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার চাওয়া। ২০২১ সালে চীন সরকার শিশুদের শিক্ষাদানব্যবস্থায় ‘দ্বৈত হ্রাস’ নীতি চালু করে। এর ফলে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে অবসর সময়ে অতিরিক্ত ক্লাস বা হোমওয়ার্কের চাপ ব্যাপকভাবে কমে যায়। এতে শিশু শিক্ষার্থী আছে—এমন প্রতিটি পরিবারের দৈনন্দিন সময়সূচিতেও আসে পরিবর্তন। এথন চীনা শিশুরা আরও বেশি খেলাধুলা ও শরীরচর্চার সময় পায়। এটি দেখা হচ্ছে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে। মহামারীর কারণে বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনযাপন ও চলাফেলায় পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা প্রতিটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আসরে আমরা মহামারীর মধ্যেই গেল বছরে চীনের শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এসেছে—তা নিয়ে আলোচনা করবো।

২০২১ সালে চীনে শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সরকারের ‘দ্বৈত হ্রাস’ নীতি। গত ২১ মে চীনের সার্বিক ও গভীর সংস্কার কমিটির অধিবেশনে স্কুলের বাইরে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া বা বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি করানো নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, চীনের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হোমওয়ার্কের চাপ গত প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অনেক পিতামাতা অন্য বাচ্চাদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ে নিজেদের বাচ্চাদের স্কুলের ক্লাসের বাইরেও অনেক অতিরিক্ত ক্লাস বা প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি করান। এতে টাকা খরচ হয়, বাচ্চাদের ওপর চাপও বাড়ে। এ প্রেক্ষাপটে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু করে জুলাই মাসের শেষ দিকে। তখন থেকে স্কুলের বাইরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্লাস বা প্রতিষ্ঠানে দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু করার পর বাচ্চাদের অতিরিক্ত ক্লাসে ভর্তির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। স্কুলের বাইরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত ক্লাস ৮৩.৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে এবং জনসেবার দায়িত্ব পালন করছে। কোটি কোটি ছাত্রছাত্রী অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং আরও বেশি খেলাধুলা ও শরীরচর্চার সুযোগ পাচ্ছে।

এর সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের হোমওয়ার্কের পরিমাণও কিছুটা কমে গেছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে শিশুদের আগে কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগতো। পিতামাতারা নিয়মিতভাবে স্কুলের হোমওয়ার্ক দেখার নোটিস পেতেন। তবে ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালুর পর বাচ্চাদের লিখিত হোমওয়ার্ক অনেক কমে গেছে। বাড়িতে ফিরে কম সময়ের মধ্যে তারা হোমওয়ার্ক শেষ করতে পারছে।

আসলে ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’র মূল উদ্দেশ্য কেবল হোমওয়ার্ক কমিয়ে দেওয়া নয়, বরং শিক্ষাদানব্যবস্থা সুস্পষ্ট করা এবং স্কুলের মূল ভুমিকা জোরদার করা।

রাজধানী বেইজিং থেকে শিক্ষকদের ব্যাপক বিনিময়ও শুরু হয়েছে। শাংহাইয়ে শিক্ষকদের ‘৫ প্লাস ২’ পদ্ধতি চালু হয়েছে। এর ফলে প্রতি সপ্তাহে ৫ কর্মদিন থাকছে এবং প্রতিদিন তাদেরকে ২ ঘন্টা ক্লাস নিতে হচ্ছে।

২০২১ সালের ৬ মার্চ বিকেলে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পি সিপিপিসিসি’র চিকিত্সা মহলের সদস্যদের সাথে আলোচনা সভায় বসেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন যে, গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকের পর জন্মগ্রহণকারী চীনারা এবং পরের প্রজন্মের চীনা যুবকরা সমানদৃষ্টিতে বিশ্বকে দেখতে সক্ষম। আমাদের চেয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। এর মূল কারণ আমাদের মাতৃভূমি দিন দিন শক্তিশালী হয়েছে এবং বড় চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তন আরো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারছে।

গত ৫ মার্চ চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং ২০২১ সালের সরকারি কার্যবিবরণীতে চতুর্থদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে চীনের উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষার সংস্কারের লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরেন। তাতে বলা হয়েছে, চীনা শ্রমিকদের শিক্ষাগ্রহণের গড় সময় ১১.৩ বছরে উন্নীত করতে হবে। একটি দেশের অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নের জন্য শ্রমিকদের শিক্ষাগ্রহণের সময় কতো বছর হতে হবে? মার্কিন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি গবেষণাগার গত ৬০ বছরের মধ্যে ১৪৬টি দেশের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে জানিয়েছে যে, একটি দেশের শ্রমিকদের শিক্ষাগ্রহণের সময় এক বছর বাড়িয়ে দিলে অর্থনীতির মোট প্রবৃদ্ধি অন্তত ২ শতাংশ বাড়ে। বিশ্ব ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে যে, একটি দেশের শ্রমিকদের শিক্ষাগ্রহণে সময় এক বছর বাড়িয়ে দিলে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ হতে পারে।

২০২০ সালে চীনের শ্রমিকদের গড় শিক্ষাগ্রহণের সময় ১০.৮ বছর ছিল—যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আধা বছর কম। এ ব্যবধান দূর করতে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিস্তারিত কাজ করেছেন। তারা মনে করেন, গত কয়েক বছরে চীনের শিক্ষাব্যবস্থা দ্রুত উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে, বাধ্যতামূলক শিক্ষার সর্বজনীনতা এবং উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণের কারণে চীনের শ্রমিকদের শিক্ষাগ্রহণের সময় ধীরে ধীরে বেড়েছে। ২০২০ সালে উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তির হার ছিল ৯১.২ শতাংশের ওপর এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার ছিল ৫৪.৪ শতাংশ। এ প্রবণতায় নতুন প্রজন্মের শ্রমিকদের শিক্ষাগ্রহণের গড় সময় ১৩.৮ বছরে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ  উচ্চশিক্ষা খাতে ভর্তির হার ৬০ শতাংশে দাঁড়াবে।

বহু বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে দেশের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে জনসংখ্যা লাভজনক সম্পদে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া, গত এপ্রিল মাসে চীনের কারিগরি প্রশিক্ষণ সম্মেলন বেইজিংয়ে আয়োজিত হয়। এতে দেশের কারিগরি প্রশিক্ষণ উন্নয়নের মৌসুমও যেন শুরু হয়। কারিগরি শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষাকে নিয়ে আসা হয় সমান অবস্থানে।

চীনের অর্থনীতি দ্রুত উন্নত হয়েছে। এতে কারিগরি প্রশিক্ষণ অতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে এবং বিভিন্ন পেশায় মোট ২০ কোটিরও বেশি সেরা শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আধুনিক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, কৌশলগত নবোদিত শিল্প ও আধুনিক পরিষেবা খাতে নতুন কর্মরত ৭০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক কারিগরি বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। তাই বলা যায়, চীনা সমাজ কারিগরি প্রশিক্ষণকে ব্যাপক স্বীকৃতি দেয়। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কারিগরি উচ্চশিক্ষার সম্পর্কে মানদন্ড প্রকাশ করে। বর্তমানে চীনের ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয় কারিগরি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করেছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ কোর্স করে স্নাতক ডিগ্রিও পাওয়া যাবে। এতে কারিগরি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থীর সমান যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন সংশ্লিষ্টরা।

বস্তুত চীনাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ কোর্সের যোগ্যতাপত্রের ওপর মনোযোগ দেওয়ার মূল কারণ কারিগরি প্রশিক্ষণের চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে কারিগরি প্রশিক্ষণের দ্রুত উন্নয়নের ফলে যুবকদের জন্য আরও বেশি আত্মউন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।  যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য এটি সহায়ক। দেশে দক্ষ কারিগর গড়ে তুলতেও তা ইতিবাচক ভুমিকা পালন রাখছে।

২০২১ সালে চীনের বিভিন্ন প্রদেশের মাধ্যমিক স্কুলের স্নাতক পরীক্ষায় খেলাধুলা বিষয়ে নম্বর আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তা থেকে বোঝা যায়, ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের শিক্ষাগ্রহণ মানে কেবল পড়াশোনা করা নয়, বরং শরীরচর্চা ও খেলাধুলাও বটে। বিশেষ করে ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু করার পর শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন রুটিনে খেলাধুলার গুরুত্ব বেড়েছে। রাজধানী বেইজিংয়ের উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণী থেকে শরীরের গুণগত মান উন্নয়নের পরীক্ষা চালু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের ওজন, ফুসফুসের ক্ষমতা, ৫০ মিটার দৌড়ানো, ১ মিনিট লাফানো, ইত্যাদি বিষয় পরীক্ষায় যুক্ত হয়েছে। এ সম্পর্কে বেইজিংয়ের শিক্ষা বিভাগের মুখপাত্র লি ই বলেন, এসব বিষয় আগেও ছিল, তবে পরীক্ষায় নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা এবারই প্রথম চালু হলো। ছাত্রছাত্রীরা শরীর ঠিক রেখে অতিরিক্ত নম্বর পেতে পারে। এতে পিতামাতারা বাচ্চাদের শরীরচর্চার প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দিতে উত্সাহিত হচ্ছেন।

বেইজিংয়ে বিভিন্ন স্কুলে খেলাধুলার বিষয় মোট ২২টি। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের প্রিয় ৪টি খেলা বেছে নিতে পারে। এভাবে তারা খেলাধুলায় ও শরীরচর্চায় ভালো করে ভালো গ্রেড পেতে পারে। খেলাধুলা বিষয়ে পরীক্ষায় সংস্কার ও ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ বাস্তবায়নের ফলে বাচ্চাদের ওপর পড়াশোনার চাপ অনেক কমেছে এবং অবসর সময়ে তারা খেলাধুলার সময়ও বেশি পাচ্ছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা ও চেতনা ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়। এখন নতুন সংস্কারের সাফল্য ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে। চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শরীরের অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। চমত্কার শরীরের অধিকারীর সংখ্যা ২০১৬ সালের ২৬.৫ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে; স্থূলতা ও মায়োপিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যাও কিছুটা কমেছে।

চীনের পরিবার শিক্ষা সহায়ক আইন চালুও ইতিবাচক ভুমিকা রাখছে। এ আইনে পরিবারিক শিক্ষাকে আইনগত দিক থেকে গুরুত্ব দিয়েছে। আগে যেটা ছিল পারিবারিক শিক্ষা তথা বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা, সেটা এখন দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পারিবারিক শিক্ষা একটি প্রয়োজনীয় ব্যাপারে পরিণত হয়েছে; আইনগত কাঠামোতে পিতামাতাদের বাচ্চাদের দেখাশোনা ও শিক্ষায় নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তা ছাড়া, বিভিন্ন পরিবারের শিক্ষাকাজে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক সহায়ক নীতিমালাও ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে।

অতীতে পারিবারিক শিক্ষার দুটি চরম রূপ ছিল। কেউ কেউ বাচ্চাদের শিক্ষার ওপর অতিরিক্ত মনোযোগ দিতেন; আবার কেউ কেউ বাচ্চাদের শিক্ষার ওপর মোটেই নজর রাখতেন না। অনেক পিতামাতা বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে করতে নিজেদের পরিচয় পর্যন্ত ভুলে যেতেন। তারা কখনও শিক্ষকের মতো, কখনও নার্সের মতো বাচ্চাদের দেখাশোনা করতেন। এতে তাদের ওপর অনেক চাপ পড়তো।

বর্তমানে সংশ্লিষ্ট আইন চালু হয়েছে। এতে পারিবারিক শিক্ষা, স্কুলের শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষা সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়ীত করা হয়েছে। পিতামাতারা এখন সহজে বাচ্চাদের শিক্ষা দিতে পারছেন। এ শিক্ষা বাচ্চাদের মানসিক অবস্থা, শরীরের অবস্থা, জীবনযাপনের দক্ষতা ও নৈতিকতার চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য বাচ্চাদের সুখে-শান্তিতে বড় হওয়ার সুযোগ দেওয়া এবং তাদেরকে দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)