বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে দিনকে দিন। জানুয়ারি মাসের প্রথম ১৫ দিনে প্রায় ২৭ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে দেশে- যা আগের মাসের অর্থাৎ ডিসেম্বরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৭ গুন বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুব বেশি না হলেও সংক্রমণের এ উল্লম্ফন স্পষ্ট করে দেয় কতটা দ্রুত অবনতি হচ্ছে করোনা পরিস্থিতির।
করোনা সংক্রমণ এমন একটা অবস্থায় যেতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞরা আগেই জানিয়েছেন এবং নিয়মিতই এ বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকে। সরকারও এ বিষয়টিকে আমলে নিয়ে ১১ দফা বিধিনিষেধ দেয়- যার ১০টিই ১৩ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবার কথা। কিন্তু ওই যে কথায় বলে- ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী!’ বরবরের মতোই মানুষ মানছে না এ সব বিধিনিষেধ। আর মানাতে সরকারের তরফে খুব একটা তৎপরতাও নজরে পড়ছে না।
এখন কথা হচ্ছে- এত তোড়জোড় করে ১১ দফা বিধিনিষেধ দেওয়া হলো করোনা সংক্রমণ বিশেষ করে অমিক্রন ঠেকাতে। কিন্তু তার কার্যকর প্রয়োগ হচ্ছে না কেন? জনগণ বরাবরের মতো গা করছে না বিষয়টিতে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই বা কতটা করছে বিধিনিষেধ বলবতে?
তবে খোদ বিধিনিষেধেই গলদের কথা বলছেন অনেকে। ১১ দফার মধ্যে এমন কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে যেগুলো বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন কেউ কেউ- অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। যেমন হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে কিংবা হোটেল থাকতে করোনা সনদ দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু- যেখানে এখনো দেশের ৫ কোটি মানুষ প্রথম ডোজ টিকা পায়নি তারা টিকার সনদ পাবে কোথায়?
সরজমিনে দেখা গেছে, প্রায় কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁই তাদের আসন ক্ষমতার অর্ধেকে গ্রাহক সীমিত রাখার বিধি মানছে না। শহরের অভিজাত এলাকার অনেকে নামী ফাস্টফুড শপেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না পুরোপুরি। অনেক জায়গায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না এখন। এমন অবস্থায় শহরের অন্যত্র কিংবা দেশের বিভিন্ন স্থানে কি পরিস্থিতি আন্দাজ করা কষ্টকর নয়।
করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গোলমাল পাকানো গণপরিবহন খাতে এবারও যেই কে সেই অবস্থা। বিধিনিষিধের ১১ দফার ১০ দফা কাগজেকলমে ১৩ জানুয়ারি কার্যকর হলেও গণপরিবহনের বিধিনিষেধ ১৫ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এ নিয়ে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিবহন মালিকদের দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। কথা ছিল অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে চলবে গণপরিবহন। কিন্তু বাস এবং লঞ্চে বরবারের মতোই মানা হচ্ছে না তা। ট্রেনে আন্তঃনগরে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন এবং স্বাস্থ্যবিধি কিছুটা মানা হলেও লোকাল ট্রেনে আসন তো বটেই দাঁড়িয়েও যাত্রী চলাচল করছে এবং তাদের কাছে স্ট্যন্ডিং টিকেট বিক্রি করছে রেল কর্তৃপক্ষ। সরকারি বিধিনিষেধ যদি সরকারি প্রতিষ্ঠান না মানে তবে অন্যরা তা মানবে- সিটি কীভাবে আশা করা যায়।
এবার আসা যাক বাসে চিরাচরিত নৈরাজ্যের দিকে। পরিবহন মালিক সমিতি থেকে ১২ তারিখ জানানো হলো অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে বাস চলবে এবং কোনো ভাড়া বাড়ানো হবে না। তার পরদিনই ১৩ জানুয়ারি পরিবহন মালিক নেতারা বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন- বিআরটিএর চেয়ারম্যান তাদের ‘যত সিট তত যাত্রী’ পরিবহনে মৌখিক সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু এটি কেমন তরো কথা- এতবড় একটা সিদ্ধান্ত বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানের মৌখিক সিদ্ধান্তে পাল্টে গেলো। আর এটি ঠিক না হলে বিআরটিএর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য তো আমরা দেখিনি।
এর বাইরে যে সব বিধিনিষিধের কথা বলা হয়ে-বিশেষ করে বন্দরগুলোতে স্ক্রিনিংসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা কতটুক কার্যকর হচ্ছে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। মানুষজন বিধিনিষেধ না মানলে মোবাইল কোর্টের কথা বলা হলেও সেটাও খুব একটা চোখে পড়ছে না।
সবকিছু মিলিয়ে ১১ দফা বিধিনিষেধ এখন পর্যন্ত অকার্যকর- একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। কোনো কোনো বিশ্লেষক বড় বড় বিধিনিষেধের কথা না বলে মাস্ক পরা নিশ্চিতে এক দফা বিধিনিষেধের পরামর্শ দিয়েছেন- তাতেও যদি কাজের কাজ কিছু হয়। তা না হলে- করোনা বিপর্যয়ে বেসামাল বাংলাদেশেকে দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে সবাইকে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন,
চীন আন্তর্জাতিক বেতার।