পাহাড়াঞ্চলের ‘অনলাইন ক্লাস’
2021-12-20 14:41:27

চীনের শহরায়ন প্রক্রিয়া উন্নয়নের সাথে সাথে গ্রামাঞ্চল বা দূরবর্তী এলাকায় বাচ্চাদের শিক্ষার ওপরও দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি চীনের হুপেই প্রদেশের এনশি শহরের তুং জাতি-অধ্যুষিত এলাকায় একটি ম্যাজিক ক্লাস চালু হয়েছে। সেই ক্লাস স্থানীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুবই মজার ও আকর্ষণীয় আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ ক্লাসের কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

 

চীনের হুপেই প্রদেশের এনশি শহরের বাচিয়াও তুং জাতি-অধ্যুষিত এলাকার বাইকুওশু প্রাথমিক স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সিয়াও ই সিন গত বছর থেকে ‘ম্যাজিক অনলাইন ক্লাসে’ অংশ নিচ্ছে। তার পিতামাতা বড় শহরে চাকরি করেন, তাই সে দাদা-দাদীর সাথে জীবনযাপন করে। গত বছরের শরত্কালীন সেমিস্টার থেকে সে প্রতি বৃহস্পতিবার সহপাঠীদের সাথে অনলাইন ক্লাস করছে। অনলাইনে সে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের কাছ থেকে বাদ্যযন্ত্র হুলুসির বাজাতে শেখে এবং সংগীতের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে।

পাহাড়াঞ্চলের ‘অনলাইন ক্লাস’_fororder_vl1

স্কুল থেকে বাসায় পৌঁছার পর নিজেকে কখনও নিঃসঙ্গ মনে হলে সে উঁচু স্থানে বসে হুলুসি বাজায়। সেমিস্টারের শেষ দিকে এসে সে দু’টি সংগীত বাজাতে শিখেছে। শিক্ষক ও অন্য শিক্ষার্থীরাও তার বাজনা অতি পছন্দ করে।

 

এটি কেবল একটি উদাহরণ। আসলে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় পাহাড়াঞ্চলে মোট ৪৭টি ম্যাজিক ক্লাসরুম স্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন ক্লাসে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ৫৮৩৭ জনে দাঁড়িয়েছে। চীনের হুপেই, সিছুয়ান, চিলিন, ইয়ুননান ও ছোংছিংয়ের ১১ হাজার জনেরও বেশি গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রী এতে উপকৃত হয়েছে ও হচ্ছে।

পাহাড়াঞ্চলের ‘অনলাইন ক্লাস’_fororder_vl2

এ সম্পর্কে উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বেচ্ছাসেবকদের পশ্চিমাঞ্চলে সেবা পরিকল্পনা’ প্রকল্পের প্রধান চাও শু ইং বলেন, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন তিনি এনশি’র গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্কুল পরিদর্শন করতে যান, তখন খেয়াল করেন যে,  স্থানীয় স্কুলের অবকাঠামো অনেক উন্নত হয়েছে, ক্লাসরুম পরিষ্কার, বহুমুখী মিডিয়া ক্লাসও নির্মিত হয়েছে, তাদের কল্পনার তুলনায় অনেক ভালো। তখন তিনি ভাবেন যে, স্থানীয় পাহাড়াঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানে কিছু সহায়তা দেওয়া যায়। কারণ, ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথাবার্তার সময় তারা খেয়াল করেন যে, দীর্ঘকাল ধরে পিতামাতার পাশে না-থাকার কারণে বাচ্চাদের মধ্যে কল্পনার অনেক অভাব। এ সম্পর্কে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকরা ‘ম্যাজিক ক্লাসরুম’ স্থাপনের পরিকল্পনা পেশ করেন। এমন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বই পড়ার চাহিদা মেটানো হচ্ছে লক্ষ্য। এখানে সংগীত, শিল্পকলা, ক্রীড়া ও মনস্তাত্ত্বিক সাহচর্যসহ অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তারা মনে করেন, শিল্পচর্চার মাধ্যমে বাচ্চাদের নান্দনিক দক্ষতা উন্নত করা যায় এবং তাদের কল্পনাশক্তিও আরও বাড়ানো যায়।

 

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ‘ম্যাজিক ক্লাসরুম’ চালু হয়েছে। এখানে ইন্টারনেট বহুমুখী ব্যবস্থাপনা, সংগীত, চারুকলার সরঞ্জাম ও বইসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। প্রতি ক্লাসরুমের বরাদ্দ ৩৫ হাজার ইউয়ানেরও বেশি। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। এ সম্পর্কে শিক্ষক চাও বলেন, “আমরা নানান পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেছি। যেমন, মেয়রসহ বিভিন্ন সরকারী কর্মকর্তাদের কার্যালয়, শিল্পপতিদের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করেছি। অনেকে তাদের এমন পরিকল্পনা সহজে বুঝতেও পারেননি।”

 

২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে চীনের একটি যুব-দাতব্য উদ্যোক্তা প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। সেই প্রতিযোগিতার সেরা প্রকল্প মোট ১ লাখ ইউয়ানের বরাদ্দ পেতে পাবে, এমনটাই কথা। তখন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকরা ‘পাহাড়াঞ্চলের ম্যাজিক ক্লাসরুম’ প্রকল্প নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং চীনের ১০ হাজারটিরও বেশি দাতব্য প্রকল্পের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেন।

 

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের চেরিফুল সুবিখ্যাত। প্রতিবছরের বসন্তকালে চেরিফুল গাছের অসাধারণ দৃশ্য ব্যাপক পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে। স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকরা চেরিফুলের পোস্টার তৈরি করেন এবং তা বিক্রি করেও কিছু টাকা আয় করেন। এনশি শহরের একজন শিল্পপতি স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের উদ্যোগ জেনে নিজে ১০ হাজার ইউয়ান দান করেন। এনশি পৌর সরকারের কার্যালয়ের কর্মীরাও স্থানীয় শিক্ষা ব্যুরোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে ‘ম্যাজিক ক্লাসরুম’ নির্মাণে সহায়তা দেন।

 

২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এনশি শহরের থুনবাও জেলার ছেবা প্রাথমিক স্কুলে প্রথম ‘ম্যাজিক ক্লাসরুম’ নির্মিত হয়। তারপর টানা দুই বছর ধরে এনশি শহরের ৭টি গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্কুলে ‘ম্যাজিক ক্লাসরুম’ নির্মিত হয়। অর্থ বাঁচাতে কাঁচামাল কেনার সময় ১০টিরও বেশি দোকানে দাম দেখে তারপর তা কেনেন স্বেচ্ছাসেবকরা। একবার তারা যন্ত্রাংশের দোকানে গিয়ে জিনিস কেনার সময় মালিক তাদের সামান্য জিনিসের দাম বিনা খরচে দিয়ে দেন। মালিক বললেন, “আপনারা বিনা খরচে বাচ্চাদের শিক্ষাদান করেন। তাই আপনাদের অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে না।”

 

‘ম্যাজিক ক্লাসরুম’ চালুর শুরুতে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকরা হুপেই প্রদেশের মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়, এনশি পেশা প্রযুক্তি একাডেমিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী স্বেচ্ছাসেবকদের আমন্ত্রণ জানান। প্রতি সপ্তাহে অনলাইন ক্লাস চালু করতে পারেন তারা এভাবে।

 

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন অধ্যাপকের সহায়তায় ‘ম্যাজিক ক্লাসরুমে’ ইতিহাস, সংস্কৃতি, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ভূগোলের পাশাপাশি বাচ্চারা ছবি আঁকা, গান গাওয়াও শেখে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেইজিং, শাংহাই ও সি’আনসহ বিভিন্ন মহানগরের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মানসিক ক্লাস চালু করা হয়।

 

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জু চুন ইয়ংয়ের ‘যৌনতা ও স্বাস্থ্য’ ক্লাস অতি জনপ্রিয়। অধ্যাপক জু’র নেতৃত্বে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে উপযোগী স্বাস্থ্যবিষয়ক ক্লাস চালু করেন। তাদের শারীরিক অবস্থা ও যৌনতার শিক্ষা দেওয়া হয়, যাতে তারা  মানসিক স্বাস্থ্যের জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

 

এনশি শহরের সানছা জেলার এক প্রাথমিক স্কুলের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক লিউ ইয়ু আকস্মিকভাবে ছাত্রী লি সিয়াও ছিয়ানের চমত্কার ছবি আঁকার দক্ষতা আবিষ্কার করেন। তিনি তাকে ছবি আঁকায় উত্সাহ দেন। এতে ছুটির দিনে ছাত্রী লি নিয়মিতভাবে ছবি আঁকা চর্চা করে। এখন মেয়ে লি’র ছবি বেশ চমত্কার হচ্ছে।

 

চীনের সিছুয়ান প্রদেশের চিয়ানইয়াং শহরের পিংশি জেলায় উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র পেং ইয়ে স্থানীয় বাচ্চাদের ইংরেজি উচ্চারণ ঠিক করতে কাজ করেন। তার উত্সাহে ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে সিয়াও মা ইংরেজি উচ্চারণ পরীক্ষায় প্রথম স্থান পায়।

 

পিংসিয়াং জেলার আরেকটি স্কুলে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকরা একজন অটিজমে আক্রান্ত ছেলের দেখা পান। ছেলেটি কথা খুবই কম বলে। পরে শিক্ষকরা তাকে নিয়ে বাস্কেটবল খেলতে শুরু করেন। একসময় ছেলেটি কথা বলতে শুরু করে। আগের চেয়ে তার মানসিক অবস্থাও অনেক উন্নত হয়েছে।

 

গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাচ্চাদের নিয়ে হুপেই প্রদেশের জাদুঘর ও উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যান স্বেচ্ছাসেবকরা। গত কয়েক বছরে মোট ২০২টি বাচ্চা উহানে বেড়াতে এসেছে। তারা উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগও পেয়েছে। অনেক বাচ্চা বলেছে, বড় হলে উহানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আসবে।

 

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন একাডেমির স্নাতক শিক্ষার্থী লি রান ছোটবেলা থেকে অনেক মানুষের সাহায্য পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথমবর্ষে সে ‘ম্যাজিক ক্লাসরুম’ প্রকল্পে অংশ নেয় এবং বাচ্চাদের নিয়ে হুপেই জাদুঘরে গিয়ে চীনের ইতিহাসের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।

 

হ্যতিয়ান গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের ‘ম্যাজিক ক্লাসরুমে’ অনলাইন ক্লাসের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সেই জন্যে তাদের ক্লাসের সময় অনেক সময় ম্যাজিক ক্লাসরুমের সময়ের সাথে খাপ খায় না। কিন্তু তারপরও তারা সুযোগ পেলে ক্লাস নেয় এবং স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের সময়মতো ক্লাসে অংশ নিতে সাহায্য করেন।

 

স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক আর বাচ্চারা ক্লাস শুরুর আগে পরস্পরের সাথে পরিচিত হয়। স্ক্রিনের অন্যদিকে বসেও স্বেচ্ছাসেবক ছেন পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের পরিবর্তন অনুভব করতে পারেন।

 

গত ১২ বছরে ‘ম্যাজিক ক্লাসরুম’ প্রকল্প আরো বেশি নতুন স্বেচ্ছাসেবককে আকর্ষণ করেছে। স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক তাদের কার্যমেয়াদ শেষ হলেও এ প্রকল্পের ওপর মনোযোগ দেয়। শিক্ষক চাও ২০১২ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করার পর একটি দাতব্য সংস্থায় যোগ দেন। পরে তিনি বাচ্চাদের যত্ন ও প্রশিক্ষণ কাজে অংশ নেন এবং সামাজিক দাতব্য কার্যক্রমের মাধ্যমে আরো বেশি বাচ্চাকে সাহায্য দেন।

 

নিজের দাতব্যকাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা আমাকে অনেককিছু দিয়েছে। মানসিকভাবে আমি সুখী। এ সুখের তুলনা হয় না। বাচ্চাদের বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবনও আরও সুখী হয়ে উঠছে।”

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)