চীনের প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
2021-12-13 17:40:04

চীন একটি জনবহুল দেশ। দেশটির লোকসংখ্যা ১৪০ কোটিরও বেশি। এর মধ্যে কিছু লোক আছেন যারা প্রতিবন্ধী। তাদের জীবনযাপন স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়। তাদেরকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা হয়েছে। ফলে আগের তুলনায় এখন প্রতিবন্ধীরা আরও বেশি করে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী লাসায় অবস্থিত প্রতিবন্ধীদের বিশেষ স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গল্প তুলে ধরবো।

 

সিইয়ং লাসার প্রতিবন্ধী বিশেষ স্কুলের অন্ধ শিক্ষক। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে তাঁর ছাত্র নিমাদর্জি চীনের একাদশ জাতীয় প্রতিবন্ধী গেমসের পুরুষদের দাঁড়িয়ে লম্বা লাফ দেওয়া প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদক অর্জন করে। শিক্ষক সিইয়ংয়ের জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার।

চীনের প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান_fororder_ls1

২০১৮ সালে শিক্ষক সিইয়ংয়ের ক্লাসে মোট ৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। নিমাদর্জি তাদের মধ্যে একজন। সে জন্মের পর থেকেই চোখে কম দেখতো। ২০১৫ সালে চোখের অপারেশনের পর তার দৃষ্টিশক্তি অনেক উন্নত হয়। এখন সে বাম চোখে প্রায় ৫০ মিটার দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। চলতি বছরের জুন মাসে প্রতিবন্ধী গেমসে খেলোয়াড়দের বাছাই পর্বে সে দাঁড়িয়ে লম্বা লাফ দেওয়া ইভেন্টে খেলার আবেদন করে। পরে ৩ মাসের প্রশিক্ষণশেষে সে জাতীয় প্রতিযোগিতার ফাইনালে রৌপ্যপদক লাভ করে। সেটি তার জন্য স্বপ্নের মতো ব্যাপার, কখনও সে এমনটা ভাবেনি।

 

চলতি বছরের জুলাই মাসে নিমাদর্জি অন্ধ মাসাজ ক্লাস থেকে স্নাতক হয়। শিক্ষক সিইয়ংয়ের দৃষ্টিতে নিমাদর্জি অনেক দক্ষ ও মেধাবী ছেলে। তাই কেবল মাসাজের ক্ষেত্রে অন্য ক্ষেত্রে সে ভালো করতে পারে। নিমাদর্জির কাছে তার শিক্ষক হচ্ছে আদর্শ। সে শিক্ষকের মতো মানুষের সেবা করতে চায়।

 

শিক্ষক সিইয়ং ১৯৯১ সালে চীনের সিছুয়ান প্রদেশের রাজধানী ছেংতু শহরের বিশেষ শিক্ষাদান স্কুল থেকে স্নাতক হন। তখন থেকে তিনি অন্ধ মাসাজকারী হিসেবে কাজ করছেন। ২০০৬ সালে তিনি লাসায় চলে আসেন এবং এ বিশেষ স্কুলে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। লাসার এ বিশেষ স্কুল ২০০০ সালের পয়লা ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি অন্ধ,  মূক ও বধির ব্যক্তিদের জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিশেষ প্রতিষ্ঠান। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই স্কুল চালু আছে। এখানে তিনটি বিভাগ চালু হয়েছে, যেখানে অন্ধ, মূক ও বধির এবং মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ক্লাস আছে। স্কুলে অন্ধ মাসাজ, থাংকা পেইন্টিং, পেস্ট্রি তৈরি ও চীনা মাটির ডিজাইনসহ ৭টি মেজর বিষয় আছে এবং স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩৬ জনে দাঁড়িয়েছে। এসব শিক্ষার্থীর খাওয়া, থাকা ও লেখাপড়ার খরচ চীন সরকার বহন করে থাকে।

 

স্কুলের কর্মজীবন সম্পর্কে শিক্ষক সিইয়ং বলেন, শুরুর দিকে ছিল অপরিচিত পরিবেশ। ছাত্রছাত্রীদের সামনেও তিনি খানিকটা অস্বস্তিতে ভুগতেন। অবসর সময়ে তিনি অফিসের বিভিন্ন ক্লাসে যাওয়া-আসা করতে এবং যাওয়ার বিভিন্ন রাস্তা মুখস্ত করার চেষ্টা করতেন। একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষক হিসেবে তিনিও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিবার ও পড়াশোনার অবস্থা জানার চেষ্টা করেন।

চীনের প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান_fororder_ls2

ছাংলা একটি মেয়ে। সে শুধু অন্ধ নয়, বরং মানসিক প্রতিবন্ধীও বটে। তাই অন্যান্য শিক্ষার্থীর তুলনায় কোনো নতুন জিনিস শিখতে তার বেশি সময় লাগে। মাসাজের কাজে দক্ষতা অর্জনের জন্য মানুষের শরীরের বিভিন্ন আকু-পয়েন্ট সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। ছাংলাকে এ দক্ষতা শেখাতে শিক্ষক সিইয়ং অনেক চেষ্টা করেন। তাকে উত্সাহ দেওয়ার পাশাপাশি, নিজে তার কাছে মাসাজ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন মেয়েটার সমস্যা কোথায়। তাঁর সাহায্যে এখন ছাংলা স্বাধীনভাবে ভালো মাসাজ করতে পারে। যদিও অন্ধ শিক্ষার্থীদের চোখের সমস্যা রয়েছে, তবে তারা বিশেষ স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর প্রায় সবাই চাকরি খুঁজে পেয়েছে, যাআ শিক্ষকের জন্য বড় অর্জন।

 

২০১৬ সালের অগাস্ট মাসে শিক্ষিকা বিয়ানবাছাংজুয়ে শিকাজের চিয়াংজি জেলা থেকে লাসায় চলে আসেন। সাধারণ শিক্ষক হিসেবে তিনি কখনও প্রতিবন্ধীদের ক্লাস নেননি। প্রতিবন্ধীদের জীবন সম্পর্কে জানতে তাই তাকে অনেককিছু শিখতে হয়। যেমন অন্ধদের ভাষায় প্রতিটি অক্ষরে মাত্র ৬টি পয়েন্ট রয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য সেটি অনুভব করা বা মনে রাখা খুবই কঠিন কাজ।

 

মেয়ে সিছ্যু ৩ বছর বয়সে অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে বাম হাত হারায়। তার মুখ ও মাথার চামড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে তার আত্মবিশ্বাসও অনেক কমে যায়। শিক্ষিকা বিয়ানবাছাংজুয়ে তার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে অনেক চেষ্টা করেন। কয়েক দিন পর মেয়ে সিছ্যুর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শিক্ষিকা তাকে নিজের মায়ের মতো দেখে। সিছ্যু’র বাড়ি স্কুল থেকে অনেক দূরে। সব ছুটিতে তাকে স্কুলে থাকতে হতো। শিক্ষিকা বিয়ানবা এ খবর জেনে নিয়মিত তাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতেন এবং তাকে সুন্দর কাপড়চোপড় কিনে দিতেন।

 

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেয়ে সিছ্যু ৯ শ্রেণীতে ভর্তি হয় এবং শিক্ষিকা বিয়ানবা’র উত্সাহে এখন তার চেহারায় মিষ্টি হাসি দেখা যায়। ২০১৯ সালে শিক্ষিকা বিয়ানবা লাসা শহরের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার লাভ করেন। তিনি বলেন, “আমি এ স্কুলে আসার জন্য পরিতাপ করি না। এখন আরও বেশি প্রতিবন্ধী বাচ্চা আমাকে মা বলে ডাকে। এটি আমার জন্য আনন্দের।”

 

চীনের নতুন পেশার সংক্ষিপ্ত পরিচয়

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের শহরায়ন দ্রুততর হয়। গ্রামবাসীরা ক্রমবর্ধমান হারে শহরে আসতে শুরু করে। তাদের আগমন শহরের সামাজিক কাঠামোতেও পরবর্তন ঘটায়। তাদের আগমনে শহরে অনেক নতুন পেশাও সৃষ্টি হয়েছে। অপরিচিত লোকের সাথে শপিং করা, অপরিচিত লোকের বাড়িতে গিয়ে বিড়াল বা কুকুরের যত্ন নেওয়া এবং কাউকে জাগিয়ে তুলতে ভোরে কলিংবেল টেপা, ইত্যাদি নতুন পেশার সৃষ্টি হয়েছে।  চীনারা এমন কাজকে সংক্ষেপে ‘সাহায্য সেবা’ বলে ডাকে।

 

চীনের শানসি প্রদেশের এক গ্রামের মেয়ে লানক্য বেইজিংয়ে বহুবছর ধরে কাজ করছেন। নিয়মিত অফিসের চাকরি তিনি করেন। পাশাপাশি তিনি ইন্টারনেট থেকে আরেকটি পেশা গ্রহণ করেছেন। তিনি অন্যদের ‘মর্নিংকল সেবা’ দিয়ে থাকেন। যারা ঘুম থেকে সকালে সময়মতো জেগে উঠতে পারেন না এবং অফিসে যেতে দেরি করে ফেলেন, তারা সাধারণ এ সেবার জন্য লোক নিয়োগ করে। অনলাইনে এমন সেবা অর্ডার করতে হয়। এ পেশা সম্পর্কে লানক্য বলেন, যদি কেউ মর্নিংকল শুনেও জেগে না-ওঠে, তবে তাকে প্রতি ৩ মিনিট অন্তর অন্তর একবার ফোন করতে হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ বার ফোন করা যায়। এ ধরনের সেবার চার্জ ১০ ইউয়ান। তা ছাড়া, তিনি অনলাইনে অস্থায়ী গাড়িচালক বা ভিডিও এডিটরসহ অনেক কাজের অর্ডার গ্রহণ করেন।

 

চাং পেং ফেই অপরিচিত লোকদের বাড়িতে গিয়ে বিড়াল বা কুকুরের যত্ন নেন। ক্রেতার অনুমোদনক্রমে তিনি দরজার লক খুলে রুমে প্রবেশ করেন এবং বিড়াল বা কুকুরকে খাবার ও পানি খাওয়ান। রুমে প্রবেশ করে ক্রেতার সাথে ভিডিও-চ্যাটেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার নিজের মূল চাকরি কুকুরের দোকানে। তাই বিভিন্ন পশুপাখি পছন্দ করি। অবসর সময়ে অন্যদের বিড়াল, কুকুর ও পাখির যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে আরও কিছু টাকা উপার্জন করতে পারি, যেটি বেশ ভালো ব্যাপার। যদি ক্রেতার কুকুর বা বিড়াল অপরিচিত লোক দেখে ভয় না-পায়, তাহলে বিভিন্ন কাজশেষে আমি তাদের সঙ্গে খানিকক্ষণ খেলাধুলাও করি।”

 

এখন চীনের ওয়েসবাইটে ‘সাহায্য সেবা’ বাটনে ক্লিক করে নানান ধরনের সেবা নেওয়া যায়। যেমন, নিঃসঙ্গ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা, বয়স্ক লোকদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, অন্যদের জন্য সুস্বাদু খাবার রান্না করা, ইত্যাদি। এমন কাজ আজকাল লোকজনকে আকৃষ্ট করছে।

 

১৯ বছর বয়সী ছেলে পান হুয়া শুধু অনলাইনে ‘সাহায্য সেবা’ দিয়ে থাকে। এ সম্পর্কে সে বলে, তার বাবা-মা কুয়াংতুং প্রদেশের চাওছিং শহরের একটি কারখানায় কাজ করেন। সে এবং তার ১০ বছর বয়সী ছোট ভাই কুয়াংসি’র গ্রামাঞ্চলের বাড়িতে জীবন কাটায়। তবে ছোটবেলায় মস্তিষ্কের টিউমার হওয়ার কারণে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। এখন সে অনলাইনে ‘সাহায্য সেবা’ দিয়ে দু’পয়সা আয় করে।

 

সে জানায়, প্রতিদিন অনলাইনে দুই বা তিনটি অর্ডার পায়। নানান ধরনের সাহায্য-সেবা দেয় সে। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। তখন একে অপরের সঙ্গে কথা বলে না; একে অপরের ফোননম্বর ব্লক করে দেয়। সে তখন নিজের ফোন থেকে ফোন করে স্বামী বা স্ত্রীর হয়ে দুঃখ প্রকাশের কাজ করে। মাঝে মাঝে কোনো কোনো লোকের মন খারাপ থাকে। তারা তখন কারুর সঙ্গে নিজের আবেগ-অনুভূতি শেয়ার করতে চায়। কথাবার্তা বললে মন হালকা হয়। এমন সেবাও সে দিয়ে থাকে। প্রতিবার এ ধরনের সেবার জন্য সে ১০ বা ২০ ইউয়ান চার্জ করে। এ কাজ নিয়ে ছেলে পান হুয়া বলে, “যদিও অন্যদের দৃষ্টিতে আমার কাজ অনেক ক্ষুদ্র, তবে আমরা এ কাজের মাধ্যমে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আয় করি। এটি কোনো লজ্জার ব্যাপার নয়।”

 

মেয়ে লানক্য বলে, “আমার জীবন কেবল অফিস ও বাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ। খুবই সহজ ও স্থিতিশীল। অন্যদের সাহায্য দেওয়ার মাধ্যমে ভিন্ন ধরনের জীবনের রূপ দেখতে পাই এবং অপরিচিত লোকদের সাথে কথাবার্তায় কোনো চাপ অনুভব করি না। এমন কাজের মাধ্যমে নিজের মানসিক অবস্থারও উন্নতি ঘটে।”

 

চাং পেং ফেই বলেন, বিড়াল বা কুকুরের যত্ন নিতে অন্যদের বাড়িতে যেতে হয়। নিরাপত্তার কারণে তিনি লককোড ও ক্যামেরা আছে—এমন বাড়িতে যেতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। এতে বিতর্ক এড়ানো সহজ হয়। ক্রেতার অনুমোদন ছাড়া তিনি তাদের পোষা প্রাণীর ছবি পোস্ট করেন না।

 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইন্টারনেট দ্রুত উন্নয়নের সাথে সাথে এখন পেশার ধরনও অনেক বেড়েছে। এমন ‘সাহায্য সেবা’ জনগণের জীবনকে সহজতর করেছে। তবে ‘অবৈধ অনুরোধ ও সেবা’ না-দেওয়া বা অতিরিক্ত চার্জ এড়ানো একটা চ্যালেঞ্জ।  এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই নতুন নতুন সেবা দিয়ে যাচ্ছে একশ্রেণির মানুষ।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)