চীনের ফু চিয়ান প্রদেশে এমন অনেক লোক আছে। ইতিহাসে তারা নৌকার বাসাতে থাকতেন। তাদেরকে চীনারা ‘লিয়ান জিয়া ছুয়ান মিন’ অর্থাত্ নৌকাবাসী বলে ডাকতো। অতীতের জীবন এখন প্রদর্শনী কেন্দ্রের ইতিহাস। বর্তমানে চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের নৌকাবাসী ছেলেদের কাছে দারিদ্র্য হলো একটি অপরিচিত শব্দ।
তীরে বড় হওয়া শিশুদের অতীত জীবন সম্পর্কে ধারণা নেই। নৌকাবাসী বংশপরম্পরায় কাঠের নৌকায় থাকতেন। নৌকা মানে বাসা, বাসা মানে নৌকা।
স্থানীয় ফু’আন শহরের সিপিসি গ্রামীণ কর্মকর্তা লিউ মিং ফু বলেন, তখন নৌকায় বেশি সময় থাকার কারণে মানুষের দুই পা আঁকাবাঁকা হয়ে যেত। নৌকাবাসী চিয়াং ছেং ছাই বলেন, তখন তাদের গায়ে পোশাক থাকতো না, আট নয় বছর বয়সেও পাজামা ছিল না। নৌকার জীবন ছিল ঠান্ডা, প্রচুর বাতাস বইতো, পেটে ক্ষুধা লেগেই থাকতো। তিনি আশা করতেন, কোনো একদিন তিনি তীরের মানুষের মতো জীবন কাটাতে পারবেন, বাড়িঘর বানাতে পারবেন।
তীরে উঠে নিরাপদ ও স্থিতিশীল জীবন কাটানো হল বংশের পর বংশ ধরে নৌকাবাসীদের অভিন্ন স্বপ্ন। শিশুদের স্কুলে ভর্তি করাও তাদের কপাল পরিবর্তনের এক চেষ্টা।
নৌকাবাসী শিশুর লেখাপড়ার জন্য এক ধরনের বিশেষ ক্লাস আছে, এর নাম ‘জোয়ার-ক্লাস’। লিন সিং জিউ এমন একটি ক্লাসের শিক্ষক ছিলেন। তিনি বলেন, যখন অল্প জোয়ার হতো, তখন জেলেদের নৌকা তীরে ভিড়তো। তখন তারা জোয়ারের সমতলে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে নৌকায় শিশুদের শেখাতেন। রাতে বাঁশের স্টিমারে হোমওয়ার্ক করত শিশুরা। তখন বৈদ্যুতিক বাতি ছিল না, তাই কেরোসিনের বাতি ব্যবহার করা হত, বেসি সময় পড়লে চোখে খুব জ্বালাপোড়া হতো।
লিয়ান ইয়ুন নৌকাবাসীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করা একজন ছাত্র। ২০০০ সালের আগে নৌকাবাসীদের মধ্যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকধারী ছিল না। লিয়ান ইয়ুন জানান, স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে স্থিতিশীল পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু নৌকাবাসীদের তীরের মানুষের মতো নিজেদের বাড়িঘর নেই। তারা নৌকায় থাকে, জোয়ার-ভাটা অনুযায়ী পরিশ্রম করে। সময়মত শিশুদের স্কুলে পৌঁছে দিতে এবং স্কুল থেকে বাসায় যেতে পারে না তারা। শিশুর জন্য দুপুর ও রাতের খাবার ভালোভাবে রান্নাও করতে পারে না। এসব কারণে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা সম্ভব হয় না। তবে লিয়ান ইয়ু খুব সৌভাগ্যবান মানুষ, তাঁর কৈশোরে নৌকাবাসীদের জীবনে বিরাট পরিবর্তন শুরু হয়।
১৯৮৮ সালের জুন মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ফু চিয়ান প্রদেশের নিংদ্য শহরে সিপিসি’র শাখা সম্পাদক ছিলেন। এই দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই তিনি ফুচিয়ান প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের সব দরিদ্র থানা পরিদর্শন করেন। নৌকাবাসীদের দরিদ্র জীবন পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৯৭ সালে সি চিন পিং ফুচিয়ান প্রদেশের সিপিসি’র উপ-সম্পাদক হন। তখন নৌকাবাসীদের তীরে উঠিয়ে স্বাভাবিক জীবন দেওয়া প্রাদেশিক কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ২০০৮ সালের শেষ নাগাদ, সি চিন পিং নৌকাবাসীদের তীরে স্বাগত জানানোর জন্য বিশেষ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেছিলেন, নৌকাবাসীদের সচ্ছল জীবন ছাড়া, পুরো প্রদেশে সচ্ছল জীবনের মিশন সম্পূর্ণ হবে না। তখন নৌকাবাসীদের তীরে এনে বসবাসের প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
নৌকাবাসী চিয়াং ছেং ছাই বলেন, গোটা জীবনে তীরে উঠে আসা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। জীবনে প্রথমবারের মতো বিদ্যুত্ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন তিনি। আনন্দে তারা পুরো রাত ঘুমাতে পারেন নি। এত আনন্দ, এত উত্তেজনা, যা সারাজীবন মনে রাখার মতো বিষয়।
সবচেয়ে আনন্দের সময় হয় শিশুদের। এখন নৌকাবাসী বংশধররা স্কুলে ভর্তি হতে পারে।
লিয়ান ইয়ুন বলেন, তাঁর মনে আছে, তখন দুপুর দুটায় স্কুলে পৌঁছাতে হতো। তবে সবাই ১টার দিকে স্কুলে পৌঁছে ক্লাসে বই পড়তো। জ্ঞান অর্জনে খুবই আগ্রহী ছিল সবাই। কোনো সহপাঠী নতুন বই আনলে সবাই তা পড়ার চেষ্টা করত।
ফু আন শহরের সি ওয়েই থানার একটি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান লিন ইয়ুং ইয়ুন বলেন, ২০১৫ সাল থেকে ফু আন শহরের প্রত্যেক বোর্ডিংয়ের ছাত্রছাত্রীকে মাসে ৬শ’ ইউয়ান ভর্তুকি দেওয়া হতো। আর স্কুলে প্রত্যেক বোর্ডিং ছাত্রছাত্রীকে ৩শ’ ইউয়ান ভর্তুকি দেওয়া হতো। এভাবে প্রত্যেক শিশুর স্কুলে ভর্তি ও পড়াশোনা নিশ্চিত করা যায়।
তারা নৌকাবাসী থেকে গ্রামের বাসিন্দা হয়েছে। নৌকাবাসীদের সামনে নতুন জীবনের দরজা খুলে গেছে। প্রেসিডেন্ট সি তখন নৌকাবাসীদের নৌকা থেকে তীরে ওঠা এবং ধনী হওয়ার আশা ব্যক্ত করেছিলেন, এখন নৌকাবাসীরা সে দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে নৌকাবাসীরা সামুদ্রিক সংস্কৃতি, পরিবহন, সিফুড উত্পাদন, প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে সচ্ছল জীবন কাটাচ্ছেন।