টিকটকে বয়স্ক মানুষের ছবি তোলা সুই খাইয়ের গল্প
2021-12-08 19:25:53

টিকটকে বয়স্ক মানুষের ছবি তোলা সুই খাইয়ের গল্প_fororder_徐凯4

এখন চীনের গ্রামাঞ্চলে তরুণ-যুবকদের খুব কম দেখা যায়। তারা জীবিকার জন্য জন্মস্থানের বাইরে চাকরি করার জন্য শহরে বাস করেন। তবে, এমন একজন তরুণ আছেন, যিনি তার ক্যামেরা দিয়ে গ্রামাঞ্চলে বাস করা বয়স্ক মানুষের ছবি তোলেন। তার নাম সুই খাই।

 

কুঁচকানো মুখ ও তাদের জীবনের গল্পগুলো যেন ধীরে ধীরে ক্যামেরায় ফুটে ওঠে। সুই খাই গ্রামাঞ্চলে গিয়ে বয়স্কদের সঙ্গে আড্ডা দেন। চলতি বছর ফসল কেমন হলো? তাদের সন্তানরা কে কোথায় আছেন—ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি খোঁজ-খবর নেন।

বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সঙ্গে গল্প করার পর সুই খাই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি  করতেন। তা হলো বয়স্কদের ছবি তোলা। ছবি তোলার পর একটি ফ্রেমে বেঁধে তাদের উপহার দিতেন তিনি। ছবিতে বয়স্ক  মানুষদের হাসি-মুখের মুহূর্তটি রেকর্ড করা হয়, দেখতে বেশ আন্তরিক ও উষ্ণতায় ভরা।

আসলে এই কাজ সুই খাই অনেক আগেই করা শুরু করেছেন।

উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে পড়ার সময় চাচা তাকে একটি ক্যামেরা উপহার দিয়েছিলেন। তিনি সেই ক্যামেরা নিয়ে জন্মস্থানের আশেপাশের গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। শুরুতে তিনি বয়স্কদের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং তাদের প্রকৃত জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। তারপর তিনি বয়স্কদের জন্য ছবি তোলেন। শুরুতে এই কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করতেন না।

 

গত বছর বয়স্কদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এবং তাদের ছবি তোলার দৃশ্য শুটিং করেন তার জনৈক বন্ধু। বন্ধু সেই ভিডিও টিকটকে পোস্ট করেন।

টিকটকে পোস্ট করা এই ভিডিও দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যা ছিল তাদের কল্পনার বাইরে।

তারপর তিনি আবিষ্কার করেন যে, অনেক মানুষ খুব সাধারণ উষ্ণতায় মুগ্ধ হয়ে যায়। তারপর টানা দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিয়মিত ভিডিও আপলোড করতে থাকেন এবং টিকটকে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। অনেকের অদ্ভুত মনে হয়েছে যে, কেন তিনি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ওপর ক্যামেরা ধরছেন? তরুণ ও সুন্দর ইন্টারনেট সেলিব্রিটির ওপর ফোকাস করলে তা আরো জনপ্রিয় হতো না?

এ বিষয়ে সুই খাই বলেন, আমি বয়স্কদের সঙ্গে গল্প করতে পছন্দ করি। তাদের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা, আনন্দ, সুখ, দুঃখ সবার সামনে তুলে ধরি। এতে সবাই যেন তাদের গল্পের মতো সারা জীবন কাটাতে পারে।

টিকটকে বয়স্ক মানুষের ছবি তোলা সুই খাইয়ের গল্প_fororder_徐凯1

আমাদের এই যুগ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সবাই ছুটে যাচ্ছে সামনের দিকে। এসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পুরানো সময়ের লোক হিসেবে দিন দিন পরিবর্তনশীল এই সমাজের সঙ্গে খাপ খাইতে পারেন না। বসবাসের গ্রাম ছাড়া, তাদের জগত্ অনেকটাই শূন্য।

সুই খাই তাদের সাদা ও কালো জীবনে একটুখানি রং দেওয়া মানুষ হয়ে উঠেছেন।

এবার আমরা সুই খাইয়ের একটি ভিডিও’র  ওপর দৃষ্টি দেবো।

একজন বৃদ্ধা, প্রতিদিন সকাল আটটার আগে সবজি বিক্রি করার জন্য বাইরে যান। সারাদিন বাজারে থাকলেও বেশি টাকা উপার্জন করতে পারেন না। তবে তার বাসা থেকে বাজার পর্যন্ত দু’ঘণ্টার পথ চলতে হয়। পাহাড়ি রাস্তাঘাটে চলাফেরা কঠিন হলেও প্রতিদিনই তাকে এ কাজ করতেই হয়। তার পরিবারে লোকজনের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। সম্ভবত প্রতিদিন বাজারে দাঁড়িয়ে তিনি প্রাণবন্ত সময় অনুভব করতে পারেন।

সুই খাই এই বৃদ্ধার ছবি তোলেন এবং তার সঙ্গে আড্ডা দেন। বিদায় নেওয়ার সময় বৃদ্ধা তাকে বলেন, ‘ভালোভাবে বেঁচে থাকো।’

এ ভিডিওয়ের নিচে একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন- ‘আমার বয়স ৩০ বছর এবং আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। আসলে আমি অনেক আগে থেকেই প্রতিদিন জীবনের শেষ দিন হিসেবে আনন্দের সঙ্গে কাটাচ্ছি। তবে এই ভিডিওতে বৃদ্ধার ‘ভালোভাবে বেঁচে থাকো’ কথাটি শুনে আমি নিজের কান্না ধরে রাখতে পারি নি। যারা অসুস্থ হয়েছেন, তাদের কাছে এই কথাটার অর্থ অনেক ব্যাপক।

 

বর্তমানে সুই খাইয়ের টিকটক আকাউন্টে ২০ লাখ ফলোয়ার আছে। তার আচরণ অনেককে উত্সাহিত করেছে। এখন অনেক লোক ক্যামেরা দিয়ে গ্রামের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ছবি তোলা শুরু করেছেন। আরও বেশি লোক গ্রামাঞ্চলের বয়স্কদের জীবনে প্রবেশ করেছেন এবং তাদের একাকী বার্ধক্য জীবনে নতুন উপাদান যোগ করেছেন। এই ইতিবাচক প্রভাব হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সুই খাই বলেন, এখন তিনি আরও অনেক বয়স্ক লোককে উষ্ণতা দিতে চান।

টিকটকে বয়স্ক মানুষের ছবি তোলা সুই খাইয়ের গল্প_fororder_徐凯2

‘কৃষকদের কৃষিজাত পণ্য বিক্রি করা’ হলো সুই খাইয়ের নতুন চিন্তাধারা। সুই খাই বলেন, একবার ভিডিও শুটিং করতে তারা শায়ানসি প্রদেশে যান। সেখানকার কৃষকরা বেশ দরিদ্র। স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক উত্স হলো লাল খেজুর রোপণ করা।  তবে সেখানে পরিবহন তেমন সুবিধাজনক নয়। লাল খেজুর পাকলেও ভালো দামে বিক্রি হয় না। একদিকে কেউ সেখানে গিয়ে লাল খেজুর কিনতে চায় না, অন্যদিকে ওখান থেকে লাল খেজুর বাইরে পরিবহনের খরচ অনেক বেশি। তাই লাল খেজুর ভালো গুণগত মানের হলেও স্থানীয় জনগণের মুনাফা কম হয়। প্রচুর পরিমাণে পাকা লাল খেজুর পচে যায়।

 

এই দৃশ্য দেখে সুই খাই ও তার দল টিকটকে লাল খেজুর বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে অপ্রত্যাশিত ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। প্রথমবার চেষ্টার পর তারা অনলাইনে নয় হাজারেরও বেশি অর্ডার পান এবং ৩ লাখ ইউয়ানের পণ্য বিক্রি হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুই খাই ও তার দল বিভিন্ন প্রদেশের গ্রামে যান এবং স্থানীয় নানা উচ্চ মানের কৃষি পণ্য দেখেন।

 

কানসু প্রদেশের হানিডিউ, ফুচিয়েন প্রদেশের জাম্বুরা এবং সিছুয়ান প্রদেশের ডালিম বেশ উন্নত। স্থানীয় কৃষকরা সারা জীবনের পরিশ্রম দিয়ে এসব কৃষিপণ্য চাষ করে আসছেন। তবে গ্রামের বাইরের মানুষের কাছে এসব পণ্য পাঠানোর কোনও সুযোগ নেই।

সুই খাইয়ের টিকটক তাদের জন্য একটি চ্যানেল সৃষ্টি করে দেয়। এসব উচ্চ মানের কৃষিপণ্য আস্তে আস্তে জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে।

সুই খাই-ও কৃষকদের মধ্যে খুব বিখ্যাত মানুষ হয়ে ওঠেন।

টিকটকে বয়স্ক মানুষের ছবি তোলা সুই খাইয়ের গল্প_fororder_徐凯

 

নিজের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলের জনগণকে সাহায্য করা এবং তাদের কৃষিপণ্য বিক্রি করে দেওয়ার মাধ্যমে জীবন উন্নত করা হলো ইন্টারনেটে জনপ্রিয়তার গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য।  

অবশ্য জনপ্রিয়তা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নানা সন্দেহের কথাও উঠে আসে। কিছু লোক জিজ্ঞাস করেন যে, কৃষকদের জন্য কৃষিপণ্য বিক্রি করে সুই খাই নিজেও টাকা উপার্জন করেন। এসব টাকা তিনি কীভাবে ব্যয় করেন?

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে খুব আকস্মিক এক সুযোগে সুই খাই এবং তার দল চিয়াং সি প্রদেশের ‘যত্নশীল রান্নাঘরের’ গল্প শুনতে পান।

 

ওয়াং নামে এক দম্পতি চিয়াংসি প্রদেশের ক্যান্সার হাসপাতালের কাছে একটি রান্নাঘর তৈরি করেছিলেন। হাসপাতালের রোগীদের আত্মীয়স্বজনরা তাদের রান্নাঘর ব্যবহার করে রোগীদের পছন্দের খাবার তৈরি করতেন। শুরুতে তারা বিনামূল্যে রান্নাঘর ধার দিতেন। তারপর প্রতীকীভাবে তারা এক ইউয়ান করে চার্জ নেন। ওয়াং দম্পতি বলেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক রোগী জীবনের শেষ দিকে পৌঁছে গেছেন। তাদের অনেকের বড় ইচ্ছা হলো জীবনের শেষ পর্যায়ে এসব রোগীকে রান্না করে সুস্বাদু খাবার খাওয়াবেন।

এই দম্পতির কাজে মুগ্ধ হয়ে সুই খাই অনেক টাকা দিয়ে তাদেরকে তেল ও চালসহ নানা জিনিস কিনে দেন। তিনি সিয়ান শহরে এমন একটি ‘ক্যান্সার রোগীদের রান্নাঘর’ স্থাপনের চিন্তাও নেন।

এখন সুই খাই শায়ানসি প্রদেশের ক্যান্সার হাসপাতালের কাছাকাছি এমন একটি রান্নাঘর তৈরি করেছেন। তিনি তার এই রান্নাঘরকে ‘নৈতিকতা, দয়া ও ভালোবাসার শেয়ারিং রান্নাঘর’ নাম দেন। এই রান্নাঘর কোনও মুনাফা লাভের জন্য নয়। প্রতিবার মাত্র এক ইউয়ান বা কয়েক ইউয়ান টাকা নেওয়া হয়। শুরুতে তিনি ও তার দল এক লাখ ৭০ হাজার ইউয়ান বরাদ্দ দেন। তাঁরা বুঝতে পারেন যে- তাদের খরচ উঠে আসতে দীর্ঘ সময় লাগবে।

তবে এজন্য তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। সুই খাই বলেন, কিছু ক্যান্সারের চিকিত্সা করা যায় না। তবে, রোগীদের ভালোভাবে খাওয়ালে এবং জন্মস্থান বা ঘরোয়া স্বাদের খাবার দিতে পারলে আত্মীয়স্বজনের আফসোস কমে যায়।

 

এই রান্নাঘরে একটি দেয়াল আছে, সেখানে প্রত্যেক রোগীর পরিবারের সুখ-দুঃখ এবং তাদের শুভকামনার কথাগুলো লেখা আছে।

কেউ লিখেছেন, জানুয়ারি মাসে আমার বাবার কিডনি ক্যান্সার সনাক্ত হয়। প্রতিদিন আমি বাবার জন্য সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে চাই। কেউ লিখেছেন, যেসব রোগীর লম্বা সময় হাসপাতালে থাকতে হয়, তাদের আত্মীয়স্বজনদের জন্য রান্নাঘর খুব প্রয়োজন। রোগীর আত্মীয়স্বজনরা সেখানে একে অপরকে সমবেদনা জানাতে পারে।

এসব কথা খুব সরল ও মনোমুগ্ধকর।

 

সুই খাইয়ের ভালোবাসার রান্নাঘর চালু হওয়ার পর টিকটকের অনেক নেটিজেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিছু মানুষ ১৬টি পাত্র কিনে পাঠিয়ে দেন, কিছু লোক রান্নাঘরের দরজার ফলক তৈরি করার দায়িত্ব নেন, কেউ আবার চাল কিনে দেন। ‘ভালোবাসার রান্নাঘর’ যেন শীতের রাতে আগুনের উষ্ণতা ছড়ায়। সব  মানুষ এতে জ্বালানি কাঠের যোগান দেয় এবং এই উষ্ণতা ছড়িয়ে যায় বহুদূর!

টিকটকে বয়স্ক মানুষের ছবি তোলা সুই খাইয়ের গল্প_fororder_徐凯3

 

সুই খাই বলেন, অনেক ফলোয়ার তাকে ম্যাসেজ দেন। তাদের কারও কথা তার মনে গভীর দাগ কাটে। এমন একটি কথা হলো, আমরা অনেক দিন ধরে জন্মস্থান থেকে দূরে ছিলাম এবং অনেক কিছু ভুলে গেছি। অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। পুনরুদ্ধার করা এসব স্মৃতি কেমন? হয়তো মাটি ও জীবনের প্রতি ভালোবাসা এবং প্রতিবন্ধকতার সামনে তাদের উদারতা। জমিতে কাজ করা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য ছবি তোলা, টিকটকে কৃষকদের জন্য কৃষিপণ্য বিক্রি করা, ক্যান্সার রোগীদের জন্য রান্নাঘর তৈরি করা—যাই হোক না কেন, সুই খাই বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে ‘ভালোভাবে বেঁচে থাকা’— এই কথাটা অনুসরণ করে চলেছেন।

 

বার্ধক্য, অসুস্থতা, রোগাক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। তাদের সেবা করার মাধ্যমে বিশ্বের কুয়াশা ও অন্ধকার দূর হতে পারে এবং আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারি।

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)