ডেলিভারিম্যান ও তাঁর মেয়ে এবং পিলিপিলি তারকা পেংপেংয়ের কথা
2021-12-06 11:31:20

সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে চীনে অনেক নতুন পেশার আবির্ভাব ঘটেছে। বিশেষ করে অনলাইন ব্যবসার দ্রুত উন্নয়নের ফলে, এ শিল্পে কর্মসংস্থানের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পরিবহনকর্মী হিসেবে অনেকে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। ‘খুয়াইতি’ বা ‘ডেলেভারিম্যান’ পেশা এখন চীনে খুবই প্রচলিত ও পরিচিত একটি পেশা। বাংলায় তাদের সরবরাহকর্মী বলা যেতে পারে। তো, এই সরবরাহকর্মীরা শহর ও জেলার মানুষের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন। আমাদের খাবার, অনলাইন কেনাকাটার জিনিসপত্র ও চিঠিসহ বিভিন্ন জিনিস তাদের মাধ্যমেই আমাদের হাতে নিত্য পৌঁছে যাচ্ছে। সম্প্রতি চীনের ওয়েবসাইটে একজন সরবরাহকর্মী লি ইউয়ান ইউয়ান ও তাঁর মেয়ের গল্প ভাইরাল হয়েছে। আজকের আসরে আমরা তাদের গল্প শোনাবো।

৩১ বছর বয়সের ডেলিভারিম্যান লি ইউয়ান ইউয়ান প্রায় ৫ বছর ধরে এ কাজ করছেন। তাঁর মেয়ে ফেরের বয়স প্রায় ৪ বছর। যখন তার বয়স ৬ মাস ছিল, তখন থেকেই সে বাবার নিত্যসঙ্গী। বাবা যখন মোটরগাড়িতে করে জিনিসপত্র বাড়ি বাড়ি ডেলিভারি দিত, তখন সেও বাবার সঙ্গে যেতো। ছোটবেলা থেকে বাবার কাজ দেখে দেখে সেও পরিশ্রমী হতে শিখেছে। এখন সে ঘরের অনেক কাজে সে সাহায্য করে। তার মিষ্টি হাসিও নেটিজেনদের মুগ্ধ করেছে।

 

লি’র জন্মস্থান আনহুই প্রদেশের তাংশান শহরে। তিনি চিয়াংসু প্রদেশের ছাংচৌ শহরে ডেলিভারিম্যানের কাজ করছেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর মেয়ে ফের জন্ম হয়। লি’র বাবা-মায়ের শরীর ভালো না। তাই তারা গ্রামাঞ্চলের বাড়িতেই থাকেন। মেয়ের জন্মের পর শুধু তার ও তার স্ত্রীর ওপরই মেয়েকে যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব পরে। তারা ঠিক করে যে, যত সমস্যাই হোক না কেন, তারা তিন জন একসঙ্গেই থাকবেন।

ডেলিভারিম্যান ও তাঁর মেয়ে এবং পিলিপিলি তারকা  পেংপেংয়ের কথা_fororder_wmbb2

২০১৯ সালের বসন্ত উত্সবের সময় ৫ মাস বয়সী ফের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং তার চিকিত্সায় লি ও স্ত্রীর সব সঞ্চয় খরচ হয়ে যায়। ফলে জীবন চালাতে লি’র স্ত্রীকে বাজারে মাংসের দোকানে চাকরি করতে হয়। প্রতিদিন ভোর ৫টায় তার কাজ শুরু হয়। তখন দু’জনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো: মেয়ের যত্ন কে নেবে?

 

বিভিন্ন বাস্তবতা বিবেচনা করে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সকালে বাবার সাথে মেয়ে থাকবে এবং বিকেলে মায়ের সঙ্গে বাজারে আসবে ফের। এ সম্পর্কে লি বলেন, ‘আমার কাজ দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত। সকালে আমি মোটামুটি ফ্রি থাকি। ২০১৬ সাল থেকে খাবার ডেলিভারির কাজ করতে শুরু করি। তাই কন্যাকে নিয়ে কাজ করা আমার জন্য কঠিন ব্যাপার নয়।’

ডেলিভারিম্যান ও তাঁর মেয়ে এবং পিলিপিলি তারকা  পেংপেংয়ের কথা_fororder_wmbb1

তখনও তিনি বাবা হননি। বসন্ত উত্সবের সময় ডেলিভারির কাজ করে মাসিক আয় করতেন ১২ সহস্রাধিক ইউয়ান। মেয়েকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তার আয় কমে যায়। তখন মাসিক ৬/৭ হাজার, মাঝে মাঝে ৮/৯ হাজার ইউয়ান আয় হতে থাকে। যদিও আয় তার একটু কমে গেছে, তবে সুখের বিষয় সবসময় তিনি মেয়ের সাথে থাকতে পারেন। এটা তার কাছে আনন্দের ব্যাপার।

 

সাধারণত সকাল ৯টা থেকে কাজ শুরু করেন লি। তখন তিনি একটি ব্যাগের মধ্যে টিস্যু ও ডায়াপার, গরম পানি ও গুঁড়া দুধসহ বিভিন্ন জিনিস নেন। সাথে তার একটি ছোট কম্বলও থাকে। মেয়ের যেন ঠাণ্ডা না লাগে, তা নিশ্চিত করতে হয় তাকে। তিনি বলেন, ‘মেয়ে আমার সাথে কাজ করতে পছন্দ করে। তার চেহারায় সবসময় মিষ্টি হাসি থাকে। সে খুবই কম কান্নাকাটি করে। আমার মোটরগাড়ি তার জন্য মজার ব্যাপার।’

 

খাবার ডেলিভারির সময় লি কখনও মেয়েকে একা ছেড়ে যান না। উঁচু উঁচু ভবনে গেলেও তিনি মেয়েকে নিয়ে যান। এভাবে মেয়ে সবসময় তাঁর পাশে থাকে। গত কয়েক বছরে মেয়ের জীবনযাত্রা সম্পর্কে লি বলেন, ‘পিতামাতার কাছ থেকে দূরে থাকা বাচ্চাদের তুলনায় আমার মেয়ের জীবন মোটামুটি ভালো। কারণ, সে সবসময় বাবা-মাকে দেখতে পায়।’

 

২০১৯ সালের মে মাস থেকে তিনি ইন্টারনেটে মেয়েকে নিয়ে খাবার ডেলিভারির ভিডিও পোস্ট করছেন। ২০২০ সালের মার্চ মাসে একজন ব্লগার তাঁর ভিডিও রিপোস্ট করেন এবং সেটি ওয়েবসাইটে অনেক জনপ্রিয়তা পায় তথা ভাইরাল হয়। পরে সিঙ্গাপুরের এক নেটিজেন লিকে জানান যে, তাঁর ভিডিও ইউটিউবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

 

এর পর থেকে তিনি খাবার ডেলিভারি দেওয়ার কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনলাইনে কিছু ব্যবসা করা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমার লাইভ অনুষ্ঠানের দর্শকের সংখ্যা কিছুদিন আগেও শতাধিক ছিল। তবে গত কয়েক দিনে আমার ভিডিও আরও বেশি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এখন আমার লাইভ অনুষ্ঠানের দর্শক আট শতাধিক।’ এটা লি’র জন্য আনন্দের ব্যাপার। আগামী বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মেয়ে ফের কিন্ডারগার্ডেনে ভর্তি হবে। তখন স্বামী-স্ত্রী আরও বেশি টাকা উপার্জনের সুযোগ পাবে। সে টাকা তারা ব্যয় করবে নিজেদের ও মেয়ের সুখী জীবনের জন্য। ‘মেয়ে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করার আগেই একটি ছোট বাড়ি কিনতে চেষ্টা করবো’, লি জানালেন।

 

ডেলিভারিম্যানের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি এ কাজ করতে গিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হয়েছি। আর মেয়েকে নিয়ে এ কাজ করার জন্য আরও বেশি লোক আমাদের গল্প সম্পর্কে জানতে পেরেছে। তাই ডেলিভারিম্যানের কাজ আমার কাছে বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ।’ নিজেদের প্রচেষ্টায় তাদের জীবন আরও সুখের হবে বলে লি বিশ্বাস করেন।

 

পিলিপিলি তারকা পেংপেংয়ের গল্প

সম্প্রতি চীনের হুনান প্রদেশের মেয়ে পেংপেং পিলিপিলি এপিপিতে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি ঐতিহ্যিক চীনা পোশাক পরে ইউরোপের অনেক সুপরিচিত শহরে গুজেং নামের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছেন, যা ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। পিলিপিলি এপিপিতে তাঁর বাজানো সুর একদিনের মধ্যে ১৬ লাখেরও বেশি মানুষের লাইক পেয়েছে।

ডেলিভারিম্যান ও তাঁর মেয়ে এবং পিলিপিলি তারকা  পেংপেংয়ের কথা_fororder_ppp

গত তিন বছর ধরে মেয়ে পেংপেং সুইজারল্যান্ডের জেনিভা, ফ্রান্সের প্যারিস ও বোর্দোসহ ১০টি শহরে মোট ২০০টিরও বেশি সুর বাজিয়েছেন। বর্তমানে পিলিপিলি এপিপিতে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। পিলিপিলি এপিপিতে তাঁর বাজানো সুর ও গানের মোট ক্লিক সংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি। ফরাসি উচ্চশিক্ষা বিভাগ তাঁকে চীনের ইন্টারনেট দূত পুরস্কার দিয়েছে এবং চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল ও বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে তিনি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছেন। 

 

বিদেশে চীনা ঐতিহ্যিক বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিয়ে পেংপেং বলেন, প্রথম রাস্তায় গুজেং বাজানোর সময় তিনি ভেবেছিলেন, কে সেটা দেখবে? যদি কেউ তাঁর সুর পছন্দ না করে, তাহলে কী হবে? কিন্তু এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই তিনি প্রাচীনকালের ঐতিহ্যিক সুর ‘উচুঁ পাহাড় ও প্রবাহিত নদী’ বাজান। সুর বাজানো শেষ হলে তিনি শুনতে পান অজস্র করতালির শব্দ। অনেক দর্শকশ্রোতা তাঁর বাজানো সুরের প্রশংসা করেন। সেই উত্সাহ ও স্বীকৃতি পেয়ে পেংপেং বিদেশের ভিন্ন শহরে তাঁর বাদ্যযন্ত্র বাজানো অব্যাহত রাখেন। কেবল চীনা ঐতিহ্যিক সংগীত নয়, বরং জাপানি কার্টুন চলচ্চিত্রের থিম সং আর পিয়ানোর জনপ্রিয় গানের সুরও  বাজিয়েছেন তিনি। চীনের সুবিখ্যাত পিয়ানো বাদক লাং লাংয়ের সাথে সহযোগিতা করে ওয়াইল্ডারনেস র‍্যাপসোডি বাজিয়েছেন।

প্রতিবার বিদেশে গুজেং বাজানোর পর তাঁর আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। কেউ তাঁকে গুজেং সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি গর্বের সাথে এর পরিচয় দেন। তিনি বলেন, এটি প্রাচীন চীনা বাদ্যযন্ত্র; এর ২০০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে।

ডেলিভারিম্যান ও তাঁর মেয়ে এবং পিলিপিলি তারকা  পেংপেংয়ের কথা_fororder_ppp2

৭ বছর বয়স থেকে গুজেং বাজানো শিখতে শুরু করেন পেং। গত বিশ বছর ধরে বাজাচ্ছেন। ২৩ বছর বয়সে তিনি উহান সংগীত একাডেমি থেকে স্নাতক হন এবং ফ্রান্সের বোর্দো সংগীত একাডেমিতে পড়াশোনা করেন। বিদেশে পড়াশোনার সময় তিনি খেয়াল করেন যে, অনেকে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে রাস্তায় বাজান। এ থেকেই রাস্তায় চীনা ঐতিহ্যিক বাদ্যযন্ত্র বাজানোর চিন্তাভাবনা তার মনে আসে। গুজেং বাজানোর পর অনেক বিদেশি তা পছন্দ করেছেন। বয়স্করা তাঁর পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে সুর শুনেন। সেটি পেংপেংয়ের জন্য আনন্দের ব্যাপার।

 

একবার পেংপেং ‘ঘোড়া প্রতিযোগিতা’ নামের সুর বাজান। তখন একটি বাচ্চা সুর শুনতে শুনতে চীনের মার্শাল আর্টের অনুকরণ করছিল। অনেক চীনা বিদেশে সুপরিচিত চীনা সুর ও গান শুনে কেঁদেছেন।

 

প্রতিবার প্রদর্শনশেষে বিভিন্ন দেশের দর্শক-শ্রোতারা যখন চীনের ঐতিহ্যিক বাদ্যযন্ত্র, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্ক জানার আগ্রহ দেখান, তখন পেংপেং ধৈর্যের সাথে তাদের তা জানান। চীনা সংস্কৃতির বিদেশে প্রচার সম্পর্কে পেংপেং বলেন, সাধারণ জীবনে চীনা সংস্কৃতির আমেজ অনুভব করা বেশ মজার ব্যাপার। তিনি ক্ষুদ্র কাজের মাধ্যমে চীনা সংস্কৃতিকে বিদেশিদের সঙ্গে  পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

 

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)