চলতি বছরের মার্চ মাসে ‘Better Days’ নামে চলচ্চিত্রটি চীনের হংকংয়ের প্রতিনিধিত্ব করে ৯৩তম অস্কারের শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক মুভির সম্মাননা জয়ের চেষ্টা করলো এবং অবশেষে পাঁচটি শক্তিশালী ছবির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ফলাফলে সব চীনারা বিস্মিত ও উত্তেজিত। সর্বোপরি, ‘Hero’ নামে চলচ্চিত্রের ১৮ বছর পর চীনের কোনও চলচ্চিত্র অস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
গত মাসে চীনের মূলভূভাগ ৯৪তম অস্কারের শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র নির্বাচনের জন্য একটি চলচ্চিত্র বেছে নেয়, যা চাং ই মৌ পরিচালিত ‘Cliff Walkers ’। বলা যায়, আসলে ‘Cliff Walkers ’ চলচ্চিত্রটি শৈল্পিক ও বাণিজ্যিক দিকে নিখুঁত ভারসাম্য বাস্তবায়িত হয়েছে। বক্স অফিসে এর আয় ১২০ কোটি ইউয়ান এবং এই সংখ্যা দিয়ে চলচ্চিত্রটি চলতি বছরের দেশীয় চলচ্চিত্রের বক্স অফিস চার্টের ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে। এটি হলো পরিচালক চাং ই মৌয়ের সেরা ব্যক্তিগত বক্স অফিস পারফরম্যান্স। ভালো বক্স অফিস অর্জন ছাড়াও, এ চলচ্চিত্রটি দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শগত রঙ থাকলেও ‘Wolf Warriors’সহ অন্যান্য মূল ধারার চলচ্চিত্রের তুলনায় এর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য তেমন সুগভীর নয়।
‘Cliff Walkers ’ চলচ্চিত্রটি হলো চাং ই মৌয়ের নবম বারের মতো অস্কারের শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের পুরস্কার জয়ের চেষ্টা। এই চলচ্চিত্রটি প্রথম আটবারের মধ্যে সাতবার চীনের মূল ভূভাগে প্রতিনিধিত্ব করে। সেগুলো হলো ১৯৮৮ সালের ‘Red Sorghum’, ১৯৯০ সালের ‘Ju Dou’, ১৯৯২ সালের ‘The Story of Qiu Ju’, ২০০২ সালের ‘Hero’, ২০০৪ সালের ‘House of Flying Daggers’, ২০০৬ সালের ‘Curse of the Golden Flower’ এবং ২০১১ সালের ‘The Flowers Of War’, তার আরেকটি শিল্পকর্ম ‘Raise the red lantern’ ১৯৯১ সালে চীনের হংকংয়ের প্রতিনিধিত্ব করে অস্কারের শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক মুভির পুরস্কার জয়ের চেষ্টা করে। এসব শিল্পকর্মের মধ্যে মোট ৩টি পুরস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এ তিনটি মুভির নাম হলো ‘Ju Dou’, ‘Raise the red lantern’ এবং ‘Hero’। চীনে এসব ছবির জনপ্রিয়তা বেশ ভালো এবং পরিচালক অ্যাং লি যৌথভাবে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
অস্কার পুরস্কার নির্বাচনে চীনের মূলভূভাগের বেছে নেওয়ার চলচ্চিত্রের দিকে নজর দিলে সহজেই দেখা যায় যে, যুগের পরিবর্তন ও উন্নয়ন যাই হোক না কেন, এসব চলচ্চিত্রের স্পষ্ট রাজনৈতিক অর্থ আছে।
১৯৭৯ সালে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের দ্বিতীয় বছরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। অস্কারে পুরস্কার জিতে নিতে চীনা চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়।
তখন থেকে পুরো ২০ শতাব্দী পর্যন্ত চীনের মূলভূভাগের বেছে নেওয়া চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ছিল যুগ ও জাতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
২১ শতাব্দীতে প্রবেশের পর ২০০১ সালে অ্যাং লি’র পরিচালিত ‘Crouching Tiger, Hidden Dragon’ চলচ্চিত্রটি অস্কারের শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করে।
পশ্চিমা বিচারকদের কাছে ‘Crouching Tiger, Hidden Dragon’ নামে চলচ্চিত্রে তুলে ধরা ওরিয়েন্টাল মার্শাল আর্টের রহস্য খুব নতুন। ‘Crouching Tiger, Hidden Dragon’ নামে চলচ্চিত্রের সফলতা মার্শাল আর্ট চলচ্চিত্রের উত্থান আবার শুরু করা ছাড়াও, মূলভূভাগের চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের রচনার অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
এর ভিত্তিতে একই স্টাইলের ‘Hero’ চলচ্চিত্রটি পশ্চিমা বিচারকদের সমাদর পেয়েছে।
তবে একই স্টাইলের মুভি বারবার দেখলেও নান্দনিক ক্লান্তি তৈরি হবে। পরের কয়েক বছরে চাং ই মৌ’র অন্য কয়েকটি চলচ্চিত্র অস্কার পুরস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় নি। শুধুমাত্র অস্কারের প্রযুক্তিগত পুরস্কার লাভ করেছে, যেমন, ‘House of Flying Daggers’ নামে চলচ্চিত্রটি সেরা ফটোগ্রাফি পুরস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ‘Curse of the Golden Flower’ চলচ্চিত্রটি সেরা পোশাক ডিজাইনের পুরস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
এবারে আমরা দেখবো আর কি কি চলচ্চিত্র অস্কার পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া হয়? প্রথমে চীনা ভাষার চলচ্চিত্রের দিকে তাকাই। চীনের হংকং ‘Zero to Hero’ নামে এ চলচ্চিত্র বেছে নেওয় হয়। এ চলচ্চিত্রটি প্যারালিম্পিকসের বিজয়ী সু হুয়া উইয়ের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে।
চীনের তাইওয়ান ‘ The Falls’ নামে চোং মোং হোংয়ের পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি বেছে নেওয়া হয়। এ মুভিটি চলতি বছর ভেনিস চলচ্চিত্র উত্সবের দি হরাইজন ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত হয়। চোং মোং হোং এনিয়ে তৃতীয়বারের মতো অস্কারের পুরস্কারের নির্বাচনে অংশ নেন।
এশিয়ায় জাপান ‘ড্রাইভ মাই কার’ বেছে নেওয়া হয় এবং এ মুভিটি কান চলচ্চিত্র উত্সবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া ‘ Escape from Mogadishu’ চলচ্চিত্রের পরিচালক সেউং ওয়ান রিউ’র চলচ্চিত্র বেছে নেওয়া হয়।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ চলতি বছর নিজেদের সবচে প্রতিনিধিত্বকারী শিল্পকর্মটি বেছে নিয়েছে। তাদের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই চলতি বছর তিনটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে এসেছে।
এখন পর্যন্ত অস্কারের পুরস্কার জিতে নিতে ৮০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চল নিজ নিজ শিল্পকর্ম বেছে নিয়েছে। বিগত ৫ বছরে এই পরিমাণ ছিল সবচেয়ে কম। এতে মহামারী পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বাস্তব অবস্থা ফুটে উঠেছে। বৈশ্বিক চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব এখনও চলছে।
অস্কার পুরস্কার পাওয়াই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এ প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন মানুষ নানাভাবে দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ বলেন, অস্কার হলো মার্কিনীদের উদ্যোগে চালু করা পুরস্কার ব্যবস্থা। গত বছর চীন ছিল বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র বাজার। চলতি বছর ‘The Battle at Lake Changjin ’ নামের চলচ্চিত্র অনেক রেকর্ড তৈরি করেছে। উচ্চ পর্যায়ের এসব সাফল্য অর্জিত হলেও অন্যদের স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করা আসলে কতটুকো দরকার? হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক দিকে আমাদের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে, বাজার বা চলচ্চিত্রের গুণগত মান, যাই হোক না কেন, চলচ্চিত্র খাতের একটি বড় দেশ হিসেবে আমাদের প্রত্যয় ও বিশ্বাস থাকতে হবে। তবে, অন্য দৃষ্টিকোণ থকে বলা যায়, অস্কার গোটা যুক্তরাষ্ট্র এবং সারা বিশ্বের দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র মানদণ্ডের প্রতিনিধিত্ব করে- তা আমাদের শেখা প্রয়োজন। তা ছাড়া, হলিউড চলচ্চিত্র বিশ্ব বাজারে শক্তিশালী প্রভাব বজায় রাখে এবং সত্যিকার সংস্কৃতি রপ্তানি করে- এই অভিজ্ঞতা শিক্ষণীয়। তাই আমাদের দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া এবং চলচ্চিত্র ও শিল্প খাতে একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এটা সত্য যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে নান্দনিক পার্থক্য এবং অস্কার সদস্যপদ ব্যবস্থার বিভিন্ন নিয়ম বিবেচনা করলে বোঝা যায়- এই অস্কার পুরস্কার পাওয়া সত্যিই সহজ কাজ নয়।
প্যারাসাইট নামে দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রের ৭২তম অস্কার পুরস্কার অর্জন দারুণ একটি ব্যাপার। সর্বোচ্চ কৃতিত্ব পাওয়ার পিছনে যে আনন্দ ও উত্তেজনা— তা আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সত্যিই চিন্তা করা দরকার।
অস্কারের সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র এই পুরস্কারকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ কেউ সারসংকলন করে বলেছেন যে, ঐতিহাসিক বিষয়, দ্বিতীয় যুদ্ধ-সংক্রান্ত বিষয়, ইহুদি, তৃতীয় জগতের জনগণের কষ্ট তুলে ধরা মুভিগুলো অস্কারে সমাদৃত হবে। তাই আমাদের খেয়াল করা উচিত্ যে, সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে কীভাবে ভালোমতো চীনা গল্প বলা যায়; চীনা দর্শকদের স্বাদ পূরণের পাশাপাশি পশ্চিমা জনগণকে সর্বজনীন মূল্যবোধ পৌঁছে দেওয়া যায়। পশ্চিমা দর্শক ও বিচারকদের নান্দনিকতা পূরণ করা নয়; বরং, ভালো একটি চলচ্চিত্রের নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড থাকতেই হবে।
‘Better Days’ নামে চলচ্চিত্রটি ৯২তম অস্কারের শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মনোমুগ্ধকর গল্প ও অনুভূতি জাতি, দেশ ও ভাষার সীমানা অতিক্রম করতে পারে।
উল্লেখ্য, ৯৪তম অস্কারের অন্তর্ভুক্তির চূড়ান্ত তালিকা আগামী বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা হবে এবং চূড়ান্ত পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ২৭ মার্চে অনুষ্ঠিত হবে।
(লিলি/তৌহিদ/শুয়েই)