শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৫ মিনিট বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৮। ইউএসজিএস জানায়, ভূমিকম্পটির উৎপত্তি স্থল মিয়ানমারের চিন রাজ্যের রাজধানী হাখা শহরের ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, মাটির ৪৮ কিলোমিটার গভীরে। তবে এতে দেশের কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি ও তার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে বাংলাদেশ ভূ-কম্পনপ্রবণ এলাকা। গোটা বিশ্বে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে এমন ২০টি শহরের মধ্যে রাজধানী ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। বৈজ্ঞানিক ব্যাখা অনুযায়ী, বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে বেশি দেরি নেই। যে কোনো সময় বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেজ্ঞরা।
যদিও স্যাটেলাইট ও অবজারভেটরি থেকে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন সহ নানা বিষয়ে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হলেও বিশ্বের কোনো দেশ আগাম ভূমিকম্প জানার ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ভূমিকম্প মানবসভ্যতার জন্য অন্যতম ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত। যেহেতু এর কোনো পূর্ব সতর্কতার বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নেই, অতএব উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পসহিষ্ণু স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ এবং দুর্যোগকালীন প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার প্রস্তুতিই হচ্ছে ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের একমাত্র করণীয় বিষয়।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৮/৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে, আরও ৮৫ হাজার ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু দালান ভাঙার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ৬-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ। এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইনস্ট সিসমিক ডিজাস্টার জরিপে ভূ-তাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম।
বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে একটি হয়েছিল ১৮৬৯ সালে সিলেট অঞ্চলের কাছার এলাকায়। রিখটার স্কেলে এ কম্পনের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল, ১৯২৩ সালের দুর্গাপুরের ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল আগে থেকেই ভীষণ ঝুঁকিতে। ভূমিকম্পের কারণে সিলেটে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়- যা এখনো রয়েছে।
ভূমিকম্পের কারণ অনুসন্ধান প্রসঙ্গে বিজ্ঞানীরা বলেন, ভূমিকম্পের মাধ্যমে মূলত ভূঅভ্যন্তরে শক্তি ও রূপান্তরের গাঠনিক প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে। বিশ্বের সাতটি প্রধান টেকটনিক প্লেটের মধ্যে তিনটি সক্রিয় প্লেটের সন্ধিস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থান করছে বাংলাদেশ।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের জনৈক পরিচালক বলেছেন, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। রাস্তাগুলো যেমন সরু, তেমন ২৪ শতাংশ রাস্তা নরম মাটি দিয়ে তৈরি। ঢাকা শহরে ভূমিকম্প হলে ফ্লাইওভার ব্রিজ ভেঙে পড়বে, বিদ্যুৎ-গ্যাস লাইনে আগুন ধরে যাবে, পানির লাইন ফেটে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো কঠিন। ঢাকা শহরে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা অনেক বেশি। ভবনগুলোও অপরিকল্পিত। তাই ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে একটির ওপর আরেকটি গিয়ে পড়বে, এতে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।
এখন স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঢাকা শহরে যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানকার রাস্তায় যদি ভূমিকম্পের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো এবং উদ্ধার তৎপরতা চালানো সত্যিই অসম্ভব কাজ হবে। তবে এই ভূমিকম্প ঠিক কখন হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ঢাকার অনিয়ন্ত্রিত ভবন ছাড়াও ভূমিকম্পে ভারী শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তবে দুর্ঘটনার আগে অযথা আতঙ্কিত না হয়ে ভূমিকম্প পরবর্তী দুর্যোগের মোকাবিলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এজন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।