বধির শিশুদের মুখে বুলি ফুটানো এক শিক্ষকের গল্প
2021-11-24 11:41:27

চীনের কুইচৌ প্রদেশের খাইলি শহরে রয়েছে একটি বধির শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র। চাও সিয়াও পিং সেখানে শিক্ষকতা করেন। তার ক্লাসে আটজন শিশু রয়েছে। তাদের গড় বয়স মাত্র ছয়বছর। তারা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

আসলে এই কেন্দ্রের শিশুদের সবাই ৩ থেকে ১০ বছর বয়সী এবং তারা সবাই শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তারা নীরব বিশ্ব থেকে বের হতে চায়। চাও সিয়াও পিং তাদের এই ব্যাপারে আশা যোগান। গেল ২০ বছরে চাও সিয়াও পিং ৬০০ শিশুকে কথা বলতে সাহায্য করেছেন। ফলে তারা সাধারণ স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছে।

হাসি ও কান্না ছাড়া সাধারণত বধির শিশুরা অন্য কোন শব্দ করতে পারে না। যদি তারা স্বাভাবিক শিশুদের মতো কথা বলতে চায়, তাহলে তাদের শ্বাস, মুখের আকৃতি, জিহ্বার অবস্থানসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয়।

একান্ন বছর বয়সী চাও সিয়াও পিং শ্যানসি প্রদেশের মানুষ। তিনি খুব ভাল ম্যান্দারিন বলেন। পাশাপাশি তাঁর মৃদু স্বরও শুনতে খুব ভালো লাগে। তিনি জানান, ক্লাসের আটজন শিশু এক বছর প্রশিক্ষণ নেয়ার পর এখন সবাই কিছু কিছু কথা বলতে পারে । চাও সিয়াও পিং মনে করেন, সবচেয়ে কঠিন এক ব্যাপার হল শিশুদেরকে কথা বলতে দেয়া।

ডিফ-এইড পরলেও শিশুরা খুব বেশি  শব্দ জানে না, ফলে অনেক শব্দই তারা বুঝতে পারে না। তাই তাদের কথা বলা শেখানোর আগে তাদের শব্দের সঙ্গে পরিচিত করাতে হয়। চাও সিয়াও পিং  বেল, টেবিল, ও ড্রামে নক করে কিছু শব্দ তৈরি করে শিশুদের বিভিন্ন কণ্ঠস্বর চিনতে সাহায্য করেন।

নিয়মিত ক্লাসের পর চাও  সিয়াও পিং কোন কোন শিশুর জন্য অতিরিক্ত ক্লাস নেন। একজন শিশুর সঙ্গে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর ও ছোট কবিতা তিনি শতাধিক এমনকি সহস্রাধিকবারও পুনরাবৃত্তি করেন।

শিশুদের বাবা-মায়েরা মনে করেন, চাও সিয়াও পিং তাদের চেয়ে শিশুদেরকে আরও বেশি বুঝেন, আর শিশুরাও তাঁকে বিশ্বাস করে।

চাও সিয়াও পিং আকস্মিকভাবে এ কাজ শুরু করেন। ১৯৯৮ সালের কোনো একদিন তিনি তাঁর বাসার কাছে একটি বধির স্কুলে দেখতে যান। সেখানে তিনি দেখেন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে শিশুরা কথা বলতে না পারলেও ইশারা ভাষায় জাতীয় সংগীত গাইছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি অবাক হন। তখন তিনি ভাবেন, যদি তারা কথা বলতে পারতো তাহলে অনেক ভাল হতো।

পরে তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁর স্ত্রী আগে থেকেই বধির শিশুদের কথা বলা শেখাচ্ছিলেন। তখন থেকে তিনিও এই কাজ শুরু করেন। ২০০১ সালে তাঁরা দুজন মিলে শ্যাসি প্রদেশের ছি সিয়ান জেলায় এই বধির শিশু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেন।

২০০৫ সালে তিনি কুইচৌ থেকে একজন শিশুর বাবা-মার কাছে জানতে পারেন, কুইচৌতে অনেক বধির শিশু আছে। তাই তাদের জন্য এমন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।  এই কথা শুনে তিনি কুইচৌ প্রদেশে যান। সেখানে তিনি আবিষ্কার করেন, প্রদেশটিতে এমন কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। তাই কুইচৌতে একটি স্কুল খুলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। শুরুতে মাত্র ছয়টি শিশু তাঁর স্কুলে আসে। তবে বিনামূল্য তাদেরকে এক মাস প্রশিক্ষণ দেন চাও সিয়াও পিং। এক মাস পর শিশুদের সবাই  বাবা-মা শব্দ বলা শিখে। এই শিশুদের বাবা-মার মাধ্যমে আরও বেশি পরিবার চাও সিয়াও পিংয়ের কথা জানতে পেরেছে।

শ্যানসি থেকে কুইচৌ পর্যন্ত গেল ২০ বছরে চাও সিয়াও পিংয়ের সাহায্যে ৬০০ বধির শিশু কথা বলা শিখেছে।

তেইশ বছর বয়সী লি সাও ছুও চাও সিয়াও পিংয়ের প্রথম শিক্ষার্থীদের একজন। লি সাও ছুও এখন বিয়ে করেছেন এবং মা হয়েছেন। লি সাও ছুও এখন স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলতে পারেন এবং সুখী জীবনযাপন করছেন। লি সাও ছুও বলেন, ‘আমি কখনও ভুলে যাব না যে, শিক্ষক চাও আমাকে কথা বলা শিখিয়েছেন’।

২০১১ সালে চাও সিয়া পিংয়ের ক্যানসার শনাক্ত হয়। অপারেশন করে তিনি সরাসরি কুইচৌতে ফিরে যান। তিনি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের বধির শিশুদের কথা মনে রেখে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে চান। স্থানীয় প্রতিবন্ধী কমিটির সাহায্যে ২০১২ সালে চাও সিয়াও পিং স্থানীয় সাত বছরের নীচে বধির শিশুদেরকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন।

ক্যানসারের কারণে তিনি তিনবার সার্জারি এবং আটবার কেমোথেরাপি গ্রহণ করেন। যদিও ডাক্তার তাকে বিশ্রাম নেয়ার পরামর্শ দেন, তবে তিনি শিশুদেরকে ছেড়ে বিশ্রাম নিতে পারেন নি। তিনি বলেন, ‘আমি সময়ের সঙ্গে একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একদিন বেঁচে থাকলে, আমি আরও একটি বেশি শিশুকে সাহায্য করতে চাই’।

চাও সিয়াও পিং বলেন, প্রশিক্ষণের চেয়ে মানসিকতা পরিবর্তন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বাবা-মায়ের শিশুদের এমন প্রশিক্ষণ দেয়ার ধারণা ছিল না। তাই চাও সিয়াও পিং মাঝে মাঝে বধির শিশুদের পরিবারে গিয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

তাঁর প্রচেষ্টায় কেন্দ্রটিতে ৮০টি শিশু যোগ দিয়েছে।  বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যা ১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। সাক্ষাত্কার শেষে চাও সিয়াও পিং বলেন, নিজের গল্প সাবাইকে জানানোর পরিবর্তে তিনি চান বধির শিশুদের পরিবারকে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনতা সম্পর্কে জানাতে। তথ্যমাধ্যমের সাহায্যে এটা আরও সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি। (শিশির/এনাম/রুবি)