চীনে পারিবারিক শিক্ষা প্রচার আইন কার্যকর
2021-11-19 17:27:09

সম্প্রতি চীনে পারিবারিক শিক্ষা প্রচার আইন কার্যকর হয়েছে। অনেকগুলো পরিবার মিলেই হয় সমাজ। আর মানুষের বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় পরিবার রাখে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এদিকে, কোনো দেশকে উন্নত হলে শিক্ষার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। তাই পারিবারিক শিক্ষাকে স্কুলের পেশাগত শিক্ষার মতোই গুরুত্ব দিতে হবে। আজকের আসরে আমরা চীনের পারিবারিক শিক্ষা প্রচার আইনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।

 

বেড়ে ওঠার সময় শিশু-কিশোররা যেসব মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়, সেগুলো যেভাবে পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব

১৯৭৮ সালের পর চীনের বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ ও সংস্কার নীতি দেশব্যাপী চালু হয়। তখন থেকে শিশু-কিশোরদের উপযোগী ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা আর যথাযথ পারিবারিক শিক্ষার চাহিদা অনেক বেড়েছে। শিক্ষাদান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে কেবল স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা রয়েছে তা নয়, বরং বিভিন্ন পরিবারেও এ দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়।

দীর্ঘকাল ধরে চীনারা স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তবে পরিবারে পিতামাতা ও বাচ্চাদের মধ্যে সম্পর্কের ওপর তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এতোদিন। কারণ, ধরেই নেওয়া হতো যে আপন বাচ্চাদের সঙ্গে পিতামাতার সুসম্পর্ক তো থাকবেই! ফলে তৃণমূলের শিক্ষকরা এটা বলতে গেলে বুঝতেই পারতেন না যে, পারিবারিক শিক্ষা উপেক্ষিত হলে শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়; বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যথাযথ পারিবারিক শিক্ষা থাকলে, এই স্পর্শকাতর সময়টায় শিশু-কিশোররা অনেক সহজে অতিক্রম করতে পারে। অন্যথায় তারা নানান মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

পারিবারিক শিক্ষাকে সমাজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে, সংশ্লিষ্ট পিতামাতাকে যথাযথ পরামর্শ দেওয়া হলে পারিবারিক শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি হতে পারে। ইতোমধ্যেই চীনের শানতুং প্রদেশের ছিংতাও ও ওয়েফাং শহরে স্থানীয় শিক্ষা ব্যুরো পারিবারিক শিক্ষা বিভাগ স্থাপন করেছে, যা সুফল দিতে শুরু করেছে।

পারিবারিক শিক্ষা পরামর্শ কমিটি গঠনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে, যাতে চীনের পারিবারিক শিক্ষার তত্ত্ব উন্নয়ন, স্কুল ও পরিবারের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু হয়। এর অর্থ স্কুল থেকে বাসায় যাওয়ার পর বাচ্চাদের সব ধরনের অতিরিক্ত অনলাইন ক্লাস আগের তুলনায় অনেক কমে যাবে; ইংরেজি, চীনা ভাষা বা গণিতসহ বিভিন্ন বিষয় স্কুলেই পড়তে হবে, এক্ষেত্রে বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেওয়া কমাতে হবে। এভাবে বাচ্চারা আরও বেশি বিশ্রাম ও শরীরচর্চার সুযোগ পাবে; সংগীত বা চারুকলাসহ অন্যান্য বিনোদনমূলক কাজে সময় দিতে পারবে।

 

গ্রামাঞ্চলে পিতামাতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেসব বাচ্চা বড় হয়, তারা উন্নত মানের পারিবারিক শিক্ষা থেকে স্বাভাবিকভাবেই বঞ্চিত থেকে যায়। চীনের আধুনিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় এ সমস্যার সমাধান অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। গ্রামাঞ্চলের বাচ্চারা দীর্ঘকাল ধরে পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। তাই তাদের জন্য পারিবারিক শিক্ষা নিশ্চিত করা উক্ত আইনের জটিল বিষয়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের পারিবারিক শিক্ষার সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ অতি স্পষ্ট। গ্রামাঞ্চলের পিতামাতাদের অনেকেই নিজেরাই যথেষ্ট শিক্ষিত নন। তাই বাচ্চাদের স্কুলের সাথে তাদের সহযোগিতার চেতনাও দুর্বল। তাদের কাছ থেকে বাচ্চারা যে পারিবারিক শিক্ষা পেতে পারে, তা তেমন উপযোগী নয়। সাধারণত গ্রামের পিতামাতারা বাচ্চাদের সাথে কথা বলার সময় সহজে রাগ করেন, অধৈর্য হন। অথচ এভাবে বাচ্চাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব নয়। পাশাপাশি দাদা-দাদী বা নানা-নানীদের মাধ্যমে বাচ্চাদের যত্ন নিলে, বাচ্চাদের দুষ্টুমি বাড়ার ও তাদের মধ্যে নানান বদ অভ্যাস তৈরির সুযোগ হয়।

এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষাবিদরা কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে থাকেন। প্রথমত, সন্তানকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পিতামাতার সনাতন ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা পিতামাতাকে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন এবং গ্রামাঞ্চলের অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষার মানদন্ড তৈরি করতে পারেন। পিতামাতাকে সঠিক চেতনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বাচ্চাদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আর ঠিক তখনই গ্রামাঞ্চলেও বাচ্চাদের সঙ্গে পিতামাতার কাঙ্খিত সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।

সরকারের নেতৃত্বে এবং স্কুল ও আবাসিক এলাকার উদ্যোগে, সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা গঠনেএ চেষ্টা করতে হবে। বাচ্চাদের পারিবারিক শিক্ষার মান উন্নয়নে বিভিন্ন পক্ষের প্রয়াস প্রয়োজন। প্রতি সেমিস্টারে পিতামাতাদের জন্য প্রশিক্ষণ-ক্লাস চালু করা প্রয়োজন। আর গ্রামাঞ্চলের পারিবারিক শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় দিক্-নির্দেশনা ও পরিষেবার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা জরুরি।

তা ছাড়া, গ্রামাঞ্চলে পারিবারিক শিক্ষার মান যাচাই ও পর্যবেক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের জন্য পারিবারিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে সহায়তা  দিতে হবে। পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন বাচ্চাদের যত্ন নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকতে হবে।

 

আইন কার্যকর করার পাশাপাশি চীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট আবাসিক এলাকার প্রশাসনিক বিভাগও বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন বাচ্চাদের সহায়তা দিচ্ছে। চলুন, চীনের চিয়াংসি প্রদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা সম্পর্কে একটু জেনে নিই।

গত কয়েক দশক ধরে চীনের শহরায়ন প্রক্রিয়ার সাথে সাথে গ্রামাঞ্চলের অনেক লোক জেলা বা শহরে চলে এসেছে এবং কৃষিকাজের পরিবর্তে তারা নতুন চাকরি-বাকরি খুঁজে নিয়েছে। তবে শহরে বসবাস ও জীবনযাপনের চাপ বেশি। ফলে তাদের মধ্যে অনেকে নিজেদের বাচ্চাদের গ্রামে রেখে শুধু নিজেরা  শহরে এসেছেন। কেবল প্রতিবছরের বসন্ত উত্সবের সময় অল্প কয়েকদিনের জন্য তারা গ্রামে গিয়ে বাচ্চাদের সাথে মিলিত হতে পারেন। ফলে চীনের গ্রামাঞ্চলের অনেক বাচ্চা শুধু নানা-নানী বা দাদা-দাদীর সাথে থাকে। এমন বাচ্চারা দীর্ঘকাল ধরে পিতামাতার সাথে দেখা না-হওয়ার কারণে এমন বাচ্চাদের অনেকেই মানসিক সমস্যা হয়। এ সমস্যার সমাধানে চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের সরকার সুবিধাজনক ব্যবস্থা চালু করেছে। যেমন, পিতামাতাদের কর্মস্থলের কাছাকাছি আবাসিক এলাকা নির্মাণ করা। এভাবে বাচ্চারা শহর বা জেলায় আসলে বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পারে। যারা এরপরও শহরে আসতে পারে না, তাদের জন্য স্বেচ্ছাসেবক পাঠানো হয়। তাঁদের সাহচর্যে অন্তর্মুখী ও লাজুক বাচ্চাদের চরিত্রও ধীরে ধীরে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে।

 

চীনের চিয়াংসি প্রদেশের চি’আন শহরের থাইহ্য জেলার একটি প্রাথমিক স্কুলে স্বেচ্ছসেবক মা বাচ্চাদের সাথে গেমস খেলেন। তিনি জানতে চান: আলু কীভাবে কাটা হবে? তখন ক্লাসের বাচ্চারা আনন্দের সাথে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় সবাই আনন্দের সঙ্গে আঙ্গুল দিয়ে বিভিন্ন আকারের আলুর বর্ণনা দেয়।

 

ক্লাস শেষ করে সবাই পাঠকক্ষে প্রবেশ করতে পারে। সেখানে বই, খেলনা ও ছবি আঁকার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে স্থানীয় বাচ্চারা এখানে সুন্দর সময় কাটাচ্ছে। এ সম্পর্কে স্বেচ্ছাসেবক মা সিয়াও রুন হুয়া বলেন, ‘যখন আবহাওয়া ভালো থাকে, তখন বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলের খেলার মাঠে ফুটবল খেলি; বৃষ্টি হলে আমরা পাঠকক্ষে বই পড়ি বা খেলনা দিয়ে খেলি।’ স্বেচ্ছাসেবক মায়ের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমার প্রথম বাচ্চার বয়স যখন ১০ মাস, তখন আমি তাকে জন্মস্থানে রেখে শহরে চাকরি করেছি। যখন ছুটিতে ফিরে যেতাম, তখন বাচ্চা আমাকে দেখে অপরিচিত মানুষের মতো আচরণ করতো। সে এখনও খানিকটা অন্তর্মুখী। তখন আমার গ্রামের কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্বেচ্ছাসেবক মায়ের কাজ করবে কি?’ তখন আমি রাজি হয়ে যাই। কারণ, আমি এমন বাচ্চাদের সাথে জীবন কাটাতে চাই। এভাবে তাদের মানসিক সমস্যা দূর করা যায়।”

স্বেচ্ছাসেবক মায়ের কাজ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, “কেবল বাচ্চাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া বা তাদের নিঃসঙ্গতা দূর করা নয়, বরং তাদের আপন বাবা-মায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করিয়ে দেওয়াও জরুরি।” তিনি একটি উইচ্যাট গ্রুপ তৈরি করেছেন। এই গ্রুপে বাচ্চারা তাদের পিতামাতার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে। গ্রুপে তিনি বাচ্চাদের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেন, যাতে পিতামাতা বাইরে চাকরি করলেও নিজেদের বাচ্চাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারেন।

 

গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য আপন বাবা-মায়ের সাথে দেখা হওয়া সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। ৭ বছর বয়সের ছেলে জুনজুন দাদা-দাদীর সাথে বাস করে। তারা স্মার্টফোন ভালো করে ব্যবহার করতে পারেন না। তাই স্বেচ্ছাসেবক মায়ের সহায়তায় জুনজুন বাবার সাথে ভিডিও-ফোনে কথা বলে। স্বেচ্ছাসেবক মা এ দৃশ্য দেখে আনন্দিত হন। তাঁর সহায়তায় ছেলে জুনজুনের চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে লাজুক ছেলেটির চোখেমুখে এখন প্রাণ ফিরে এসেছে যেন।

 

এ সম্পর্কে স্বেচ্ছাসেবক মা খাং এন ফেং বলেন, “তাদের দেখে আমার আপন বাচ্চার কথা মনে হয়, মনে হয় আপন বাচ্চারই  যত্ন নিচ্চি।” শিক্ষক খাং আগে একটি কিন্ডারগার্ডেনে চাকরি করতেন। ২০১৯ সালে তিনি স্বেচ্ছাসেবক মায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেড় বছরের মধ্যে তাঁর যত্নে বাচ্চারা বড় হয়েছে। তার এখন আর নিঃসঙ্গ লাগে না। নিজের কাজকে তিনি অনেক তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করেন এবং কাজটি উপভোগ করেন।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)