১৬শ’রও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল মা’
2021-11-16 16:03:28

১৬শ’রও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল মা’_fororder_zhan1

২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি, চান ওয়েন বিমানযোগে চীনের কুয়াং চৌ শহরে পৌঁছান। বিমান পৌঁছার মুহূর্তেই তিনি কাঁদতে শুরু করেন। দুই ঘণ্টার বিমানযাত্রা শেষ হয়। তিনি চীনের কুয়াং চৌ শহরের থিয়ান হ্য এলাকার চ্য বো প্রাথমিক স্কুলের প্রিন্সিপাল এবং না ইয়ুং থিয়ান হ্য প্রাথমিক স্কুলের প্রথম প্রিন্সিপাল হিসেবে তাঁর কুই চৌ প্রদেশের না ইয়ুং জেলায় তিন বছর সহায়তা দিয়েছেন।

তিনি কুয়াংচৌ শহরে পৌঁছার এক মাস পর রাজধানী বেইজিং শহরে এসে ‘দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি’ হিসেবে দেশের দারিদ্র্যবিমোচন পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তখন থেকে ১৬শ’রও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল মা’ চান ওয়েন সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

 

ছোটবেলা থেকে চান ওয়েনের বাবা সবসময় তাঁকে শেখিয়েছেন ‘Suffering is a blessing’ বা কষ্ট হলো আশীর্বাদ। কষ্টকর জীবন থেকে মানুষ শক্তি অর্জন করে। চান ওয়েনের বাবা তরুণ বয়সে দেশের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের নির্মাণকাজে সহায়তা দেওয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে চান ওয়েনের মাকে সঙ্গে নিয়ে সিন চিয়াংয়ের আকসু এলাকায় যান। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আকসু এলাকার তা লি মু নদীর তীরে উট লালন-পালন করতেন, ধান চাষ করতেন। কারণ, চান ওয়েনের বাবা মাথা টাক করতে পছন্দ করেন, তাই সবাই তাঁকে ‘টাক মাথার চাচা’ হিসেবে ডাকে। সবাই বলে যে, ‘টাক মাথার চাচা’ থাকলে খাওয়ার কোনো চিন্তা নেই’। চান ওয়েনের বাবার পরিশ্রম সবার প্রশংসা পেয়েছে।

 

চান ওয়েনের মা একজন দর্জি। চান ওয়েনের মনে পড়ে, উত্সবের সময় লোকজন এসে নতুন পোশাক তৈরি করতে চায়। মা সবচেয়ে ভালো জিনিস তাদের জন্য তৈরি করেন। যেটা ভালো না, সেটা নিজের জন্য রেখে দেন। চান ওয়েন ছোটবেলায় শিখেছেন যে, তাঁর পারিবারিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল দুর্বল গোষ্ঠীর প্রতি যত্ন নেওয়া।

 

বাবা-মা চান ওয়েনের জন্য খুব ভালো দৃষ্টান্ত রেখেছেন। ১৯৯৭ সালে চান ওয়েন কুয়াং চৌ শহরের থিয়ান হ্য এলাকায় গিয়ে সেখানে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। তিনি ৭টি স্কুলে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১০ সাল থেকে চান ওয়েন গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে শিক্ষকতার সহায়তামূলক কাজে অংশ নেওয়া শুরু করেন। কিন্তু স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি দীর্ঘসময় ধরে স্কুল ত্যাগ করে দূরবর্তী এলাকায় গিয়ে সহায়তা দিতে পারতেন না।

 

২০১৭ সালে কুই চৌ প্রদেশের না ইয়ুং জেলা এবং কুয়াং চৌ শহরের থিয়ান হ্য এলাকার শিক্ষকতার কাজে সহযোগিতা সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই সুযোগে চান ওয়েন না ইয়ুং জেলায় গিয়ে দীর্ঘসময় ধরে সহায়তা দেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।

প্রথমবারের মত কুই চৌ প্রদেশে এসে তাঁকে অনেক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। সেখানে পাহাড় অনেক বেশি, তবে চান ওয়েন এমন পথে গাড়িতে থাকলে অসুস্থ হয়ে যান, তার ঠান্ডার ভয় লাগে। তবে না ইয়ুং জেলার পাহাড়ি এলাকার আবহাওয়া ঠান্ডা ও আর্দ্র। তিনি ঝাল খেতে পারেন না, তবে স্থানীয় খাবারে ঝাল অনেক বেশি। পরিবেশের বিরাট পরিবর্তন এবং স্থানীয় জীবনের মান শহরের চেয়ে অনেক অনুন্নত। তবে তা সত্ত্বেও চান ওয়েন ছেড়ে দেয়ার কথা কখনই ভাবেন নি।

 

না ইয়ুং জেলায় তিন বছরে, চান ওয়েন স্থানীয় শিশুদের নিজের শিশু হিসেবে দেখেন, শিশুর পরিবারকে নিজের আত্মীয় হিসেবে মনে করেন। স্থানীয় মানুষজন খুব অবাক হয় যে, চান ওয়েন প্রত্যেক দরিদ্র শিশুর বাসা কোথায়, তা মনে রাখেন, প্রত্যেক পরিবারের অবস্থা ভালোভাবে জানেন, কোনো পরিবারে সুখবর থাকলে তিনি সময়মত শুভেচ্ছা জানান।

 

না ইয়ুং থিয়ান হ্য প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক লি ফাং জানান, কখনই চান ওয়েনের মতো প্রিন্সিপাল দেখি নি। তিনি একদিকে শিশুদের লেখাপড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন, অন্যদিকে শিশুদের জীবন ও মানসিক অবস্থার প্রতিও কেয়ার করেন। তিনি না ইয়ুং জেলার শিক্ষা খাতের শ্রেষ্ঠ একজন মানুষ।

চান ওয়েনের কাহিনী না ইয়ুং জেলায় প্রায় সবাই জানে। ২০২০ সালে না ইয়ুং থিয়ান হ্য প্রাথমিক স্কুল নতুন শিক্ষক ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তখন ৯ শতাধিক শিক্ষক চান ওয়েনের সুনাম শুনে সেখানে আবেদন করেন।
 

তবে, মানুষের শক্তির সীমা আছে। চান ওয়েন না ইয়ুং জেলার শিক্ষা কাজে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন, হাজার মাইল দূরের কুয়াং চৌ শহরের পরিবারের ওপর তিনি বেশি মনোযোগ দিতে পারেন নি। তাঁর ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সময় তিনি সঙ্গে থাকতে পারেন নি। যখন তাঁর বাবা মারা যান, তখন তিনিও ফিরে যেতে পারেন নি। তা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ।

১৬শ’রও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল মা’_fororder_zhan2

সৌভাগ্যের বিষয় হল চান ওয়েনের পরিবার দৃঢ়ভাবে চান ওয়েনকে সমর্থন জানায়। না ইয়ুং জেলার শিশুরা চান ওয়েনকে চিঠি লিখেছিল, এসব চিঠি দেখে মুগ্ধ হয়ে চান ওয়েনের ছেলে চান ওয়েনকে জেলায় ফিরে কাজ করার পরামর্শ দেন। যখন তাঁর বাবা ক্যান্সারের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন চান ওয়েন ছুটি নিয়ে বাবার সঙ্গে থাকতে যান, তবে তাঁর বাবা বলেছিলেন, না, জেলায় থাকো, শিশুদেরকে সাহায্য করো।

চান ওয়েন তার ত্যাগের কথা বেশি বর্ণনা করতে চান না।  শুধু বলেন: সব কিছুই অতীতের কথা। তিনি এখন যেটা করতে পারেন, সেটা হল আরো পরিশ্রম করা। যাতে স্বর্গে থাকা বাবা তা দেখে খুশি হন।

সাংবাদিক চান ওয়েনকে জিজ্ঞেস করেন, দেশের বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকায় শিক্ষা কাজে সহায়তা দানকারী শিক্ষককে তিনি কি বলতে চান। চান ওয়েন বলেন, শিক্ষক হিসেবে, এই জীবনে নিশ্চয়ই একবার দূরবর্তী এলাকায় সহায়তা দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়; এমন অভিজ্ঞতা ছাড়া শিক্ষক জীবন অসম্পূর্ণ হয়। তিনি এমন কঠিন কাজ করা শিক্ষককে সম্মান করেন। তিনি আরো বলেন, মনে রাখতে হয়, শিক্ষা কাজে সহায়তা দেওয়ার সময় লেখাপড়ার প্রতিও মনোযোগ দিতে হয়। কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য না বা সুনাম অর্জনের জন্য না। আন্তরিকভাবে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে থাকতে হয়। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। স্থানীয় লোকজন স্পষ্টভাবে তোমার আচরণ বুঝতে পারবে। লোকজনের মূল্যায়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

 

২০২০ সালের শুরুতে যখন করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হয়, তখন তা চান ওয়েনের শিক্ষা পরিকল্পনা বিশৃঙ্খল হয়। নতুন সেমিস্টার শুরু হতে যাচ্ছিল, তবে মহামারি ভালোর দিকে যায় না। তিনি প্রতিরোধমূলক পোশাক ও মাস্ক পরে কুই ইয়াংয়ে যাওয়ার ফ্লাইটে ওঠেন। তখন মহামারির অবস্থা খুব কঠিন ছিল, পুরো ফ্লাইটে শুধু পাঁচজন যাত্রী ছিল। যাত্রা শুরুর আগে তিনি স্বামীকে বলেন, যদি তাঁর কোনো দুর্ঘটনা ঘটে বা রোগাক্রান্ত হন, তাহলে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যান্য মানুষকে দান করে দিতে হবে।

 

পরদিন, চান ওয়েন অন্য তিনজন স্কুল প্রধানের সঙ্গে তিন মাস চেষ্টা করে স্কুলের স্বাভাবিক পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হন। চান ওয়েন স্কুলের সব কিছুই ভালোমতো জানেন। স্কুলের আয়তন ২০ হাজার ৭৮১ বর্গমিটার। শিক্ষক ও কর্মীর সংখ্যা ৭০ জনেরও বেশি, মোট ২৬টি ক্লাস আছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬০০ জনেরও বেশি। তিনি না ইয়ুং থিয়ান হ্য প্রাথমিক স্কুলকে নিজের ‘শিশু’ হিসেবে দেখেন।

 

‘লৌহ মানবী’ হয়েও চান ওয়েনের শারীরিক অবস্থা ভীষণ ব্যস্ততায় খারাপ হতে থাকে। ২০২০ সালের মে মাসে তাঁর একটি ছোট অস্ত্রোপচার হয়। তবে কুয়াং চৌ শহরে ফিরে বিশ্রাম নেয়ার সময়ও পান নি তিনি। মাত্র তিন দিন বিশ্রাম নিয়েছেন তিনি, তারপর তিনি আবারও কাজে ফিরে যান। তাঁর স্বামী না ইয়ুং জেলায় এসে তাঁর যত্ন নেন, তিনি অবাক হন যে, এত ব্যস্ততা চান ওয়েন কীভাবে ম্যানেজ করেছেন।

 

সবচেয়ে কঠিন সময় চান ওয়েন কয়েকবার বুঝতে পারেন যে, তিনি যেন পড়ে যাচ্ছেন। তবে যখন তিনি স্কুলে শিশুদের হাসিমুখ দেখেন, তখন তিনি আবারও শক্তি পান। শিশুদের চোখে, চান ওয়েন তাদের ‘প্রিন্সিপাল মা’। আবহাওয়া অনেক খারাপ হলেও প্রতিদিন সাড়ে সাতটায় স্কুলের মেইন গেটে দেখা যায় প্রিন্সিপাল মার হাসি মুখ। তিনি প্রত্যেক শিশুকে সকালের শুভেচ্ছা জানান, আলিঙ্গন করেন, শিশুরা তাঁর ভালোবাসায় নতুন একটি দিন শুরু করে।

 

না ইয়ুং থিয়ান হ্য প্রাথমিক স্কুলে ৮৫ শতাংশ শিশুর পরিবার দরিদ্র। আর অনেক শিশুর বাবা মা শহরে কাজ করে, তাদের যত্ন নিতে পারে না। এসব শিশুর নানা মানসিক সমস্যা হয়। চান ওয়েন এর ওপর অনেক গুরুত্ব দেন। প্রতিদিন স্কুলের কাজ শেষে তিনি নিয়মিত শিশুদের বাসায় যান, এসব শিশুকে মানসিক সাহায্য দেন তিনি।

 

চান ওয়েন বলেন, প্রতিটি শিশুর পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা ও কঠিনতা আছে। বয়স্ক দাদা দাদি বৃষ্টির মধ্যে তাদের নাতিকে খোঁজেন। যে শিশুটির স্কুলের শ্রেণিকক্ষে বসে লেখাপড়ার কথা ছিল, কিন্তু বাবা মা’র যত্নের অভাবে তারা স্কুলচ্যূত হয়। এ অবস্থা দেখে চান ওয়েন খুব মর্মাহত হয়। যখন এসব পরিবারের দুঃখ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন চান ওয়েন মনে করেন, তিনি যথেষ্ট করতে পারেন নি, তিনি আরো বেশি কাজ করার চেষ্টা করেন।

 

নিজের টাকায় গরীব পরিবারের জন্য জিনিসপত্র কিনে দেন, স্কুলচ্যুত শিশুদের স্কুলে ফিরে আসার ক্ষেত্রে পরামর্শ ও সাহায্য করেন। চান ওয়েন নিঃস্বার্থ হৃদয় দিয়ে সবাইকে সমর্থন দেন।

এ ছাড়া, চান ওয়েন স্থানীয় শিক্ষকের সঙ্গে বাইরে গিয়ে আধুনিক শিক্ষার চেতনা শেখার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেন। ২০১৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত, না ইয়ুং জেলার শতাধিক শিক্ষক চান ওয়েনের সাহায্যে কুয়াং চৌ শহরের থিয়ান হ্য এলাকায় গিয়ে আধুনিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। তিনি বলেন, প্রিন্সিপালের উচিত একটি স্থান তৈরি করা, যাতে প্রত্যেক শিক্ষক নিজের স্থান খুঁজে পান।

 

পুরো তিন বছরে চান ওয়েন এক দিনও ছুটিও নেন নি। একবারও ভ্রমণ করেন নি। তিনি নিজেকে না ইয়ুংয়ের মানুষ মনে করেন। না ইয়ুং যেন তাঁর দ্বিতীয় বাসা।

তিনি বলেন, সুযোগ থাকলে তিনি আবারও না ইয়ুং জেলায় ফিরে যেতে চান।

(শুয়েই/তৌহিদ/ সুবর্ণা)