চীনের ‘দুটি বোমা, একটি উপগ্রহ’ গবেষক ছেং খাই চিয়া’র গল্প
2021-11-15 16:50:21

১৯৬৪ সালের ১৬ অক্টোবর বেইজিং সময় বিকেল ৩টায় চীনের প্রথম পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালানো হয়। এ কাজের জন্য চীনের বহু বিজ্ঞানী নিস্বার্থে অবদান রেখেছেন এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বিজ্ঞানী ছেং খাই চিয়া তাঁদের মধ্যে একজন। পরে তিনি চীনের ‘দুই বোমা, এক উপগ্রহ’ বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে চীনের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পুরস্কার অর্জন করেন। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন। আজকের আসরে আমরা শিক্ষাবিদ ছেং খাই চিয়া’র গল্প তুলে ধরবো।

চীনের ‘দুটি বোমা, একটি উপগ্রহ’ গবেষক ছেং খাই চিয়া’র গল্প_fororder_ckj1

১৯১৭ সালে ছেং খাই চিয়া জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের বড় নাতী হিসেবে দাদা তাকে খাইচিয়া বলে ডাকতেন। তাঁর নামের অর্থ রাষ্ট্রীয় পরীক্ষায় শ্রেষ্ঠ রাঙ্কিং পাওয়া। ১৯৩১ সালে তিনি চেচিয়াং প্রদেশের চিয়াসিং শহরের সিউচৌ মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুলে চীনের ১০ জন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ পড়াশোনা করেছেন। তিনি টানা ৬ বছর এ স্কুলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য স্টাইলের শিক্ষা গ্রহণ করেন। স্কুলে অধ্যয়নকালেই তিনি বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন।  

 

১৯৩৭ সালে তিনি চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। তবে সেই সময় চীনে জাপানি আগ্রাসন শুরু হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট জু খ্য চেনের নেতৃত্বে তাঁদের স্কুল পশ্চিমাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়। অবশেষে ২৬০০ কিলোমিটার যাত্রাশেষে তারা কুইচৌ প্রদেশের মেইথান জেলায় পৌঁছান।

 

চীন অনেক বড় দেশ। তবে জাপানি আগ্রাসি বাহিনীর দখলে শান্তিপূর্ণভাবে পড়াশোনার সুযোগ পায়নি চীনা শিক্ষার্থীরা। তখন থেকেই তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করার লক্ষ্য ঠিক করেন। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ডক্টর জোসেফ লি’র সুপারিশে তিনি ব্রিটেনে পড়াশোনা করতে যান এবং পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাক্স বর্নের শিক্ষার্থী হন।

 

১৯৪৯ সালে যখন তিনি স্কটল্যান্ডে ছিলেন, তখন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ সামরিক জাহাজ কর্তৃক চীনের ইয়াংসি নদীতে চীনা গণমুক্তি ফৌজের নদী অতিক্রমে বাধা দেওয়ার দৃশ্য দেখেন। তবে চীনা বাহিনী সাহসের সঙ্গে তাদের বাধা ডিঙ্গিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সামরিক জাহাজ আত্মসমর্পণ করে। এ দৃশ্য দেখে তিনি অনেক গর্বিত হন এবং বিষয়টি তাঁর মনে গভীর দাগ কাটে। ৯০ বছর বয়সেও তিনি সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, তখন থেকেই তিনি চীনা জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পান।

 

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর তিনি স্বদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। অনেক সহপাঠী তাঁকে ব্রিটেনে বসবাস করার পরামর্শ দেয়। কারণ, তখন চীন অনেক দরিদ্র ও দুর্বল একটি দেশ। তবে তিনি মাতৃভূমির উন্নয়নে নিজের অবদান রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। দেশে ফিরে এসে তিনি চীনের প্রথম পারমাণবিক বোমার গবেষণায় যোগ দেন। ২০ বছরের মধ্যে তিনি চীনের পারমাণবিক বোমা,  হাইড্রোজেন বোমা ও পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রসহ ৩০টিরও বেশি পরমাণু পরীক্ষায় অংশ নেন। তিনি সাফল্যের সঙ্গে পারমাণবিক পরীক্ষা-গবেষণাগার নির্মাণ করেন, যা চীনের পারমাণবিক প্রযুক্তি-গবেষণাগারের অভাব পূরণ করে।

 

১৯৬০ সালের গ্রীষ্মকালে নানচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট কুও ইং ছিউ অধ্যাপক ছেং খাই চিয়ার হাতে একটি ঠিকানাসম্বলিত কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘বেইজিংয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তুমি কালই সেখানে চলে যাও।’ এ কথা শুনে তিনি কাগজে লেখা ঠিকানায় পৌঁছান। তখন থেকে তাঁর নাম রাষ্ট্রীয় শীর্ষ গোপন ফাইলে অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি চীনের প্রথম পারমাণবিক বোমার গবেষক হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র-গবেষণাগারের উপপরিচালকে পরিণত হন। তাঁর প্রধান কাজ ছিল পারমাণিবক বোমার বিস্ফোরণের সমীকরণ নিয়ে গবেষণা করা।

 

১৯৬২ সালের গ্রীষ্মকালে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু হয়। ছেং খাই চিয়া পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার একজন প্রযুক্তিগত দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। তিনি চীনের রাষ্ট্রীয় পরীক্ষামূলক গবেষণাকাজের কার্যক্রম ও জরুরি গবেষণা থিসিসসহ বিভিন্ন নিয়মবিধি প্রণয়ন করেন। তাঁর পরামর্শেই চীনের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এ সম্পর্কে চীনের শিক্ষাবিদ চু কুয়াং ইয়া বলেন, চীনের পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ পূর্ব-পরিকল্পনার আগেই সম্পন্ন হয়েছিল।

 

১৯৬৪ সালের ১৬ অক্টোবর চীনের প্রথম পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১৭০০টিরও বেশি যন্ত্রপাতি পরীক্ষার তথ্য সংগ্রহ করে। সেইদিন থেকে চীনকে নতুন দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে সারা বিশ্ব।

 

পরে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশের উদ্যোগে ‘বায়ুমণ্ডলে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। ফলে ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নেন অধ্যাপক ছেং। ১৯৬৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চীন প্রথমবারের মতো সাফল্যের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় এবং তা ছিল চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।

 

জনাব ছেং বহুবার বলেছেন, তিনি চান চীন উন্নত হবে এবং দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হবে উন্নত। চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কারণে তিনি চীনে ‘পারমাণবিক কমান্ডার’ নামেও সুপরিচিত।

 

২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি মরুভূমিতে গবেষণার কাজ করেছেন। পারমাণবিক পরীক্ষা-গবেষণাগারের প্রধান ও পারমাণবিক পরীক্ষাঘাঁটির ভাইস কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তাঁর দক্ষতায় চীন বহুবার পারমাণবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।

 

নিরাপত্তার ইস্যু পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই এ সম্পর্কে তিনি কখনও শিথিলতা দেখাননি। ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষার বিস্ফোরণেও অবশ্যই বিকিরণ হয়। এ সমস্যার সমাধান করার জন্য অধ্যাপক ছেং খাই চিয়া অন্যান্য গবেষকদের সাথে নিয়ে প্রচুর কাজ করেন। ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য তিনি দেড় বছর সময় নিয়ে খননকাজ করার প্রস্তুতি নেন। যখন খননকাজ শুরু হয়, তখন আশেপাশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। তিনি নিজে খননকৃত গুহায় প্রবেশ করে পর্যবেক্ষণকাজ পরিচালনা করেন এবং বহুবার গুহা, করিডোর ও পরীক্ষাগারের কাছে বিস্ফোরণের বিভিন্ন সম্ভাব্য তথ্য সংগ্রহ ও হিসাব-নিকাশ করেন। যখন চীন ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষার খুব কাছাকাছি সময়ে চলে আসে, তিনি ঝুলন্ত ঝুড়িতে বসে খননকৃত বিশাল গুহার ভিতরটা দেখতে চেয়েছিলেন। তবে ঝুলন্ত ঝুড়িতে এভাবে বসা আসলে অতি বিপজ্জনক কাজ। যখন তিনি ১০০ মিটার নিচে নামেন, তখন কর্মীরা তাঁর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাকে আরও বেশি নিচে নামতে দেননি। পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ওপর তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন।

 

চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তিনি গবেষকদের নিয়ে চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজনীয় তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর ১০১ বছর বয়সী শিক্ষাবিদ ছেং খাই চিয়া দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তবে তাঁর গভীর কর্মনিষ্ঠা ও অজানাকে জানার বিপুল আগ্রহ এবং তার কাজ নতুন প্রজন্মের গবেষকদের আজও উত্সাহ যোগায়। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)