১৫ দিনের ইউরোপ সফর শেষ করে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সফরে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় বিশ্ব জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৬-এ যোগ দেন। লন্ডন হয়ে ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে প্যারিস যান। সেখানে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। বৈঠক করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ও প্রধনমন্ত্রীর সঙ্গে, স্বাক্ষরিত হয় তিনটি চুক্তি ও সমঝোতাস্মারক। প্যারিসে ইউনেস্কো-বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল অর্থনীতি পুরস্কার প্রদান করেন শেখ হাসিনা। যোগ দেন ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ বেশ কিছু উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে। ফরাসি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী, পরিদর্শন করেন ফরাসি সিনেট। প্রধানমন্ত্রীর এবারের ফ্রান্স সফরকে ফলপ্রসু ও ঐতিহাসিক হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
৯ নভেম্বর প্যারিস পৌঁছলে বিমান বন্দরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ স্ট্যাটিক গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। ওইদিনই তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাখোঁ ও প্রধানমন্ত্রী জ্যঁ কাস্টেক্সের সঙ্গে বৈঠক করেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাসভবন এলিসি প্রাসাদে প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। দু’নেতা সেখানে একান্ত বৈঠক করেন। পরে ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।
প্যারিসে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে ব্রিফ করেন তার সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। জানান, প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সংক্রান্ত ৩টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে ফ্রান্স আরও ৩৩ কোটি ইউরো সহায়তা দেবে। বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য ফ্রান্সের বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন ফরাসি নেতারা।
১০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ফরাসি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। এতে প্রধানমন্ত্রী ২০২৫ সালের মধ্যে দু’দেশের বাণিজ্য ২০০ কোটি ডলার থেকে ৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যের কথা জানান। বাংলাদেশ ফ্রান্সের পঞ্চম বিনিয়োগ গন্তব্য-উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইন্দো-প্রশান্তমহাসগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ। ফরাসি ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের বিনিয়োগ সুবিধা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ-ফ্রান্স বিজনেস কাউন্সিল গঠনের জন্য ফরাসি ব্যবসায়ীদের সংগঠন এমইডিইএফকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফরাসি সিনেট পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী সিনেটে পৌঁছলে সদস্যরা দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রশংসা করে একটি মানপত্র পাঠ করা হয়। ফ্রান্সের ইন্টার পার্লামেন্টারি গ্রুপের সভাপতিসহ সিনেটে বাংলাদেশ বিষয়ক গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী।
১২ নভেম্বর প্যারিস পিস ফোরামে একটি উচ্চ পর্যায়ে প্যানেল আলোচনায় যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা মহামারি মোকাবেলায় সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে যে ব্যবধান- সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
একই দিন প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কো-বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সৃজনশীল অর্থনীতি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সৃজনশীল অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য বিশ্বের ৬৯ প্রতিষ্ঠানকে টপকে প্রথমবারের মতো এ পুরস্কার জিতে নেয় উগান্ডার যুব-উদ্যোক্তা সংগঠন এমওটিআইভি ক্রিয়েশন্স লিমিটেড। প্রধানমন্ত্রী সংগঠনের উদ্যোক্তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। সম্মাননার পাশাপাশি সংগঠনটি প্রাইজমানি হিসেবে পেয়েছে ৫০ হাজার ডলার।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তিতে বঙ্গবন্ধুর অবদানের প্রতি সবচেয়ে বড় সম্মান ইউনেস্কোর এই পুরস্কার প্রবর্তন। যুবকদের অগ্রাধিকার দিয়ে চালু করা এ পুরস্কার ইউনেস্কোর অবদানকে আরও সম্প্রসারিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বসম্প্রদায়ের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে বাংলাদেশরে আগ্রহের কথ জানান।
১৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে বক্তৃতায় শেখ হাসিনা করোনা মহামারি পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল সক্ষমতা বাড়ানোসহ ৪টি প্রস্তাব তুলে ধরেন।
সবকিছু মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের প্যারিস সফর ছিল কর্মমুখর এবং তাৎপর্যপূর্ণ। গ্লাসগোয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে যেমন প্রধানমন্ত্রী অন্যতম নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন তেমনি প্যারিসে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি বাংলাদেশের ভামমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্যারিসে ব্রিফিংয়ে প্রধনমন্ত্রীর এ সফরকে ঐতিহাসিক হিসেবে অভিহিত করে বলেন, অতীতে বাংলাদেশের আর কোনো প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সে এত সম্মান পাননি।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।