প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রী হোক, সর্বশেষ বর্ষের শিক্ষার্থী হোক, তারা যে স্থান থেকেই আসুক না কেন, শিক্ষার্থীরা জীবনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করুক না কেন, তারা সবাই স্কুলের ১০ হাজার মিটার দৌড়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এবং এ থেকে ‘দৃঢ়তা, সাহস এবং নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার’ শক্তি সঞ্চয় করে। এই উপহার তাদের সঙ্গে থাকবে, তাদেরকে আরও বড় বিশ্ব গঠনে নেতৃত্ব দেবে।
প্রথমবার দশ হাজার মিটার দৌড়ানো শেষে ছাত্র লু চেন হুং হাঁটার সময় যেন দুই পা কাঁপতে থাকে। শরীরের ভিতর থেকে যেন গরম বাতাস বের হতে থাকে। হোস্টেলে গোসল করার পরই তার মুখ লাল হয়ে যায়।
এক বছর চর্চার পর চলতি বছর ছাত্র লু উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হয়। তার শরীর এ খেলার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ১০ হাজার মিটার দৌড়ানো শেষ হলে অল্প একটু বিশ্রামের পর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়।
দশ হাজার মিটার দৌড়ানো কেমন ব্যাপার?
যখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মনে করতো যে ৮শ’ মিটার দৌড়ানোর পরীক্ষাও খুব ভয়ংকর ব্যাপার, তখন চীনের কুও হুয়া স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রতি সপ্তাহে ১০ হাজার মিটার দৌড়ানো অভ্যাসের মতো স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুও হুয়া একটি বিশেষ বিদ্যালয়। চীনের কুয়াং তুং প্রদেশের ফো শান শহরে এটি অবস্থিত। এখানে উচ্চ বিদ্যালয়ের তিন বছরের লেখাপড়ার ফি, থাকা এবং খাওয়া একদম ফ্রি। যদি ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে, তাহলে বিদ্যালয়টি তার লেখাপড়া ও অন্যান্য সব খরচ বহন করে।
এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে দুটি শর্ত পূরণ করতে হয়। পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ হওয়া এবং লেখাপড়ায় অনেক ভালো হওয়া। কুও হুয়ার ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই বিদ্যালয় খুব ভালো লেখাপড়ার পরিবেশ দেয়। তারা শুধু মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে।
কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসের পর জীবন গঠনের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। লেখাপড়ার ফলাফল সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, তবে ভালো গুণ ও চরিত্র গঠন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দশ হাজার মিটার দৌড়ানো, এক দিনের চাকরি করার অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন বিশেষ কোর্সও আছে এই উচ্চ বিদ্যালয়ে।
কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে হুয়াং হুয়া কেং স্বচক্ষে দেখেছেন দশ হাজার মিটার দৌড়ানোর ঘটনাটি।
ছাত্রছাত্রীদের শরীরচর্চা এবং ভালো চরিত্র গঠন করার জন্য উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কুও হুয়া বিদ্যালয়ের ক্লাসের মাঝখানে দৌড়ানোর অভ্যাস ছিল। কিছু কিছু শিক্ষার্থী তাড়াতাড়ি ক্লাসে ফিরে লেখাপড়া করার জন্য দুই সার্কেল কম দৌড়াত। তাই কুও হুয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটি উপায় বের করেন। তারা দৌড়ানোর সমাপ্তিরেখা বিদ্যালয় থেকে ১ হাজার মিটার দূরের একটি নদীর তীরে রাখেন। শিক্ষকরা নদীর তীরে ছাত্রছাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থী সেখানে পৌঁছানোর পর এই দৌড়ানো শেষ হয়।
হুয়াং হুয়া কেং-এর মনে খুব গভীর দাগ কাটে শিক্ষকের একটি কথা “এখানে তোমাদের লেখাপড়া না-করার চিন্তা আমাদের নেই, শুধু চিন্তা করি, তোমরা শুধুই লেখাপড়া করো।
দৌড়ানোর দৈর্ঘ্য ১০ হাজার মিটারে বাড়ানোর এই প্রস্তাব দিয়েছেন হুয়াং হুয়া কেং-এর ক্লাসের প্রধান শিক্ষক। তিনি বিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগ নেন, শুরুতে তিনি শুধু ছাত্রছাত্রীদের ‘সহ্য ক্ষমতা বৃদ্ধি’ অনুশীলন করতে চান, তবে তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি যে, এই চেষ্টা বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে পরিণত হবে। প্রতি সপ্তাহে কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের দশ হাজার মিটার এবং ছাত্রীদের আট হাজার মিটার দৌড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।
ছাত্র লু হুং চেনের মনে আছে, উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম বছরে প্রিন্সিপাল জি দ্য হুয়া নতুন শিক্ষার্থীদের মাঝে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। যখন দশ হাজার মিটার দৌড়ানোর কথা উল্লেখ করেন, তখন সবাই অবাক হয়। নতুন শিক্ষার্থীরা এতে খুব উদ্বিগ্ন হয়েছিল।
তখন ছাত্র সুই খ্য এর অর্থ বুঝতে পারে নি। “আমি খেলোয়াড় হতে চাই না, কেন ১০ হাজার মিটার দৌড়াব?” অসংখ্যবার দৌড়ানোর সময় সে ভেবেছিল, হয়তো কোনো একদিন এই স্কুল থেকে পালিয়ে যাবে। তবে সে এ চেষ্টা কখনওই করে নি; বরং সে আস্তে আস্তে এই দৌড়ানোর সঙ্গেই খাপ খাইয়ে নেয়।
শুরুর দিকে, অনেক শিক্ষার্থী সুই ক্য-র মত চিন্তা করতো। তবে, যখন তারা সত্যিই একবার দশ হাজার মিটার দৌড়ানো শেষ করে, তখন তারা আবার এতে অংশ নেওয়ার সাহস ও শক্তি পায়।
কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে এক সার্কেল ৪০০ মিটার, ১০ হাজার মিটার দৌড়তে ২৫ সার্কেল পূরণ করতে হয়। সুই ক্য মাঝে মাঝে দেখেছে, কেউ কেউ যেন আর দৌড়তে পারে না, তবে সে হাল ছেড়ে দেয় না, একটু একটু করে এগিয়ে যায়। পাশের ছাত্রছাত্রীরাও তাকে উত্সাহ দেয়।
বিশেষ করে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময়, কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষকরা বিশেষভাবে নিজের ছাত্রছাত্রীদের বলেন যে, যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের দেখবে, তখন তাদেরকে উত্সাহ দিও।
সুই খ্য প্রত্যেকবার উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের দেখলে তাদের উত্সাহ দেয়। সে মনে করে, মাঝে মাঝে, জীবনের ছোট একটি মুহূর্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারে। সে কল্পনা করে, যখন সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল, তখন নিম্ন শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা তাকে উত্সাহ দিলে তার ভালো লাগতো।
বাঁশি শোনার পর প্রতি সেকেন্ড দৌড়ানো মানে নিজের জন্য একটি অগ্রগতি। একটি সার্কেল দৌড়ানো ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। মাঝে মাঝে দৌড়ানোর পর হোস্টেলে ফিরে সুই খ্য’র অনেক ক্লান্ত লাগে, এ অবস্থায় পোশাক না ধুলে চলবে?
সে বলে, না।
ছাত্র লু হুং চেন বলে, প্রতি সপ্তাহে কোনো দুশ্চিন্তা হলে দৌড়তে যাবো। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে সব চিন্তা চলে যায়। দৌড়ানোর সময় শরীর খুব ক্লান্ত হলেও, মানসিক শক্তি অনেক বেড়ে যায়। রাতে গোসল নেওয়ার পর বেশ ফ্রেশ লাগে।
দশ হাজার মিটার দৌড়ানোর কাজ- যেন এক শিক্ষকের মতো কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে অনেক বুদ্ধি ও শক্তি যুগিয়েছে।
আসলে দশ হাজার মিটার দৌড়ানো সহজ কাজ নয়, লেখাপড়া ও জীবনে কিছু কঠিনতা থাকে। তবে সুই খ্য জানে, দৌড়ানোর পথে সে একা নয়। দৌড়ানোর সময় উচ্চ বিদ্যালয়ের চিকিত্সক ও নার্সরাও তাদের সঙ্গে থাকে। ছাত্রছাত্রীদের কেউ অসুস্থ হলে তাদের দ্রুত সাহায্য দেওয়া হয়।
সুই খ্য’র মনে আছে, একবার দশ হাজার মিটার দৌড়ানোর সময়, উচ্চ শ্রেণীর একজন ছাত্রী হঠাত্ খুব ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তবে মাটিতে পড়ার পরই চিকিত্সক দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। তারপর তার সহপাঠী ও শিক্ষকরা এসে যায়। সুই খ্য বুঝতে পারে যে, এই তিন বছরের লেখাপড়া কখনও অনেক কঠিন মনে হলেও, বিপদের সময় সবাই পাশে থাকবে ও সাহায্য করবে।
২০ বছর ধরে কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দশ হাজার মিটার দৌড়ানোর ব্যবস্থা চালু রেখেছে। এটি সব শিক্ষার্থীর অভিন্ন স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।
হুয়াং হু কেং হুনান প্রদেশের পাহাড়ি এলাকা থেকে আসা এক শিক্ষার্থী। তিনি কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম শিক্ষার্থী। কুও হুয়া থেকে বের হবার পর হুয়াং হুয়া কেং চীনের চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন। এখন তিনি পেশাদার আইনজীবী। কাজের পাশাপাশি তিনি একজন আইনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দরিদ্র মানুষদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন। তিনি হুয়াং হুয়া কেং পাহাড় থেকে শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ফ্রন্ট লাইনে দৌড়ানো শুরু করেছেন।
উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতকের পর প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কিছু সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজের কল্যাণে অংশ নেন।
২০২০ সালে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত দেশের বাধ্যতামূলক শিক্ষার ভারসাম্য উন্নয়ন যাচাই অবস্থা অনুযায়ী, ২০২০ সালে চীনের সব জেলায় বাধ্যতামূলক শিক্ষার হার ৯৫ শতাংশে উন্নীত হয়- যা দেশের মানদণ্ডের জন্য অনুকূল।
ভবিষ্যতে শহর ও গ্রামীণ শিক্ষার ভারসাম্য আরও উন্নত হবে। দূরবর্তী এলাকার শিশুরা উন্নতমানের শিক্ষা লাভ করবে।
কুও হুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর চরিত্র ভিন্ন, স্বপ্নও ভিন্ন, তবে তাদের অভিন্ন ভালো গুণ আছে। তারা সমাজের বিভিন্ন মহলে কাজ করে, তারা নিজের ভালো গুণ দিয়ে আরও বেশি মানুষের কল্যাণ করবে।
(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)