নারী নভোচারী প্রসঙ্গ
2021-11-08 15:32:37

গত ১৬ অক্টোবর চীনের শেনচৌ-১৩ নভোযানে চড়ে তিন জন চীনা নভোচারী মহাশূন্যে পাড়ি জমান। তাঁরা থিয়ানকুং মহাকাশকেন্দ্রের মূল অংশ থিয়ানহ্য-তে টানা ৬ মাস থাকবেন, গবেষণা করবেন। তিন নভোচারীর মধ্যে রয়েছেন একজন নারী, যার নাম ওয়াং ইয়া পিং। তাঁরা এবারের যাত্রায় চীনা নভোচারীদের মধ্যে মহাশূন্যে সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে থাকবেন। আর ওয়াং ইয়া পিং হলেন চীনের মহাকাশকেন্দ্রের প্রথম নারী নভোচারী। প্রশ্ন হচ্ছে: পুরুষ ও নারী নভোচারীদের প্রশিক্ষণের মধ্যে কি পার্থক্য আছে? একজন নারী নভোচারী মহাশূন্য কী কী বিশেষ চ্যালেঞ্জ বা ঝামেলার সম্মুখীন হতে পারেন? নারী নভোচারীরা পুরুষদের তুলনায় কোনো বিশেষ সুবিধা কি পেয়ে থাকেন? আজকের আসরে আমরা এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

নারী নভোচারী প্রসঙ্গ_fororder_as1

মহাকাশে নারী নভোচারীদের পুরুষ নভোচারীদের তুলনায় বেশি অসুবিধা মোকাবিলা করতে হবে

নভোচারীদের মহাকাশে পাড়ি জমানোর আগে অনেক কঠিন প্রশিক্ষণ নিতে হয়। মহাকাশের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে মাধ্যকর্ষণের অস্তিত্ব নেই। যে-কোনো সময় বড় ধরনের বিপদও হতে পারে তাদের। ওজন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। কোনো কোনো সময় নভোচারীদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই নভোচারীদের কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। নারী নভোচারীরাও এর ব্যতিক্রম নন। বর্তমানে চীনে পুরুষ ও নারী নভোচারীরা প্রায় একই ধরণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তবে, কোনো গর্ভবতী নারী এমন প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারেন না স্বাভাবিক কারণেই।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারী নভোচারীদের বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে মানদন্ড ও নিয়মে খানিকটা পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়নে নারী নভোচারীদের নির্বাচন-পদ্ধতি ছিল খানিকটা ভিন্ন। ১৯৬৩ সালে বিশ্বের প্রথম নারী নভোচারী হন ভ্যালেন্টিনা ভ্লাদমিরোভনা তেরেশকোভা। তিনি ছিলেন স্কাইডাইভার, কোনো পেশাদার বিমানচালক নন। নভোচারীদের মধ্যে ফ্লাইট বিশেষজ্ঞ ও কার্যক্রম বিশেষজ্ঞ থাকেন। ফ্লাইট বিশেষজ্ঞ সাধারণত জঙ্গিবিমান চালকদের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হয়। তবে কার্যক্রম বিশেষজ্ঞদের কাজ নানান ধরনের। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট শতাধিক নারী নভোচারী নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের সংখ্যা নভোচারীদের মোট সংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ এবং তাদের মধ্যে অনেকে কার্যক্রম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। এর মূল কারণ হল নারী ও পুরুষ নভোচারীদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। এ কারণে নারীরা মহাশূন্যে থাকাকালে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। মহাকাশে নারী নভোচারীদের তুলনামূলকভাবে বেশী পানি পান করতে হয় এবং তাদের জন্য বিশেষ পণ্যও লাগে।

বিশ্বের প্রথম নারী নভোচারী ভ্যালেন্টিনা ভ্লাদমিরোভনা তেরেশকোভা ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন ওরিয়েন্টাল-৬ মহাকাশযানে চড়ে মহাশূন্যে পাড়ি জমান। তাঁর কখনও বিমানচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি নিজের অবস্থা সমন্বয় করে, মহাকাশে জৈবিক চিকিত্সা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেন। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে, মহাকাশে নারীরাও পুরুষদের মতো কাজ করতে পারে।

তবে তেরেশকোভা মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসার পরের ১৯ বছরে আর কোনো নারী নভোচারী হবার সুযোগ পাননি। ১৯৮২ সালের ১৯ অগাস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় নারী নভোচারী স্যাভিকাভা মহাকাশে যান। তিনি চমত্কারভাবে মহাশূন্যে তার কাজ সম্পন্ন করেন এবং ১৯৮৪ সালের ২৫ জুলাই একমাত্র নারী নভোচারী হিসেবে মহাশূন্যে পদচারণা করেন। তা ছাড়া, তিনি নভোযানের প্রকৌশলীর সহায়তায় ধাতু কাটা ও ঢালাইয়ের কাজ করেন। এ থেকেও বোঝা যায়, নারীরা কেবল মহাশূন্যে জীবন কাটাতে নয়, বরং বিভিন্ন জটিল কাজ করতেও সক্ষম।

১৯৯৫ সালের ২২ মার্চ রুশ নারী নভোচারী কোন্ডাকোভা ‘জোট টিএম-২০’ নভোযানে চড়ে মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। তিনি মহাকাশকেন্দ্রে মোট ১৬৯ দিন কাটিয়েছেন এবং মহাশূন্যে একজন নারী হিসেবে অবস্থানের নতুন বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেন। আসলে এ যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল, নারীদের ওজনহীন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর অবস্থা পরীক্ষা করা। এর আগে নারী নভোচারীরা মহাশূন্যে ১৫ দিনের বেশি কাটাননি। অথচ তিনি প্রায় আধা বছর মহাকাশে কাটিয়ে দেন।

২০১৪ সালে, ২০ বছর পর, আরেকজন রুশ নারী নভোচারী আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রে পৌঁছান। তাঁর নাম ইয়েলেনা সেরোভা, যিনি মহাকাশকেন্দ্রে ছয় মাস অবস্থান করেন।

মহাকাশে যাওয়া ও মহাকাশে পদচারণা করা প্রথম নারী নভোচারী সোভিয়েত ইউনিয়নের। তবে এ পর্যন্ত মহাশূন্যে যাওয়া সবচেয়ে বেশি নারী নভোচারী যুক্তরাষ্ট্রের। তাদের প্রায় ৫০ জন নারী নভোচারী মহাশূন্যে নানান ধরনের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী নভোচারী ১৯৮৪ সালের ৮ নভেম্বর ‘ডিস্কাভারি’ নভোযানে চড়ে মহাশূন্যে যাত্রা করেন। তিনি বিয়ে করেন এবং প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তান প্রসব করার পর মহাকাশ অভিযানে শরিক হন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপারেশানের মাধ্যমে যেসব নারী সন্তান জন্ম দিয়ে থাকেন, তাদের জন্য মহাকাশে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

মার্কিন নারী নভোচারী আইরিন মারি কলিন্স ১৯৯৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ‘ডিস্কভারি’ নভোযানে চড়ে মহাশূন্যে যান এবং ১৯৯৯ সালের ২৩ জুলাই কমান্ডার হিসেবে ‘কলম্বিয়া’ নভোযানে চড়ে আবার মহাশূন্যে যান।

২০০১ সালের ১১ মার্চ মার্কিন নারী নভোচারী হেলমস মহাশূন্যে পদচারণার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। তিনি আরেক জন পুরুষ নভোচারীর সাথে নভোযান থেকে বেরিয়ে মহাশূন্যে প্রায় ৯ ঘন্টার মতো কাজ করেন। সেটি এ পর্যন্তও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময়ের রেকর্ড।

২০০৭ সালের ১২ অক্টোবর মার্কিন নারী কমান্ডার হুইটসন আরেকটি রেকর্ড সৃষ্টি করেন। তিনি মহাশূন্যে মোট ১০ বার পদচারণা করেন এবং এ কাজে তিনি মোট সময় নেন ৬০ ঘন্টা ২১ মিনিট। তিনি মহাকাশে কাটান ৬৬৫ দিন ১৭ ঘন্টা ২২ মিনিট।

২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রে প্রথমবারের মতো ম্যারাথন সম্পন্ন করেন মার্কিন নারী নভোচারী উইলিয়ামস। আবার ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ৪৬ বছর বয়সী উইলিয়ামস মহাশূন্য স্টেশনে ট্রায়াথলন চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করেন।

তা ছাড়া, মার্কিন নারী নভোচারী ক্রিস্টিনা হ্যামক কোচ ২০২০ সালে টানা ৩২৮ দিন ধরে মহাশূন্যে থাকেন। নারী নভোচারীদের মধ্যে এটি নতুন রেকর্ড।

বিদেশি নারী নভোচারীদের সম্পর্কে জানা হলো। এবার আসুন চীনের নারী নভোচারীদের ওপর খানিকটা আলোকপাত করি। চীনের প্রথম নারী নভোচারীকে বেছে নেওয়া হয় পরিবহনবিমানের চালকদের মধ্য থেকে। কারণ, সেই সময় চীনে জঙ্গিবিমানের নারীচালক ছিল না। ২০১২ সালের ১৬ জুন চীনের শেনচৌ-৯ মানববাহী নভোযানে প্রথম নারী নভোচারী লিউ ইয়াং মহাকাশে পাড়ি জমান। মহাশূন্যে যাওয়ার পর তিনি নারীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন এবং এমন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ চীনের মহাকাশকেন্দ্রের জন্য উপযোগী নারী নভোচারী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে।

নারী নভোচারী প্রসঙ্গ_fororder_as2

চীনের নারী নভোচারীর মহাশূন্যে জীবনমান নিশ্চিত করতে শেনচৌ-৯ নভোযানে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। যেমন, নারী নভোচারীর কাপড়, আসন আর তাদের বিশেষ কাপড়ের সেট রাখা হয়। তাদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি পণ্যের সরবরাহও রয়েছে। নারীর হাত পুরুষদের চেয়ে ছোট। তাই নারীর হাতের আকারের ভিত্তিতে বিশেষ গ্লাভস তৈরি করা হয়। নারীদের ওয়াশরুমও তৈরী করা হয় একটু ভিন্নভাবে।

ওয়াং ইয়া পিং চীনের সপ্তম দলের নারী নভোচারী, যিনি ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৩ সালে শেনচৌ-১০ নভোযানে করে মহাকাশে পাড়ি জমান।  তিনি থিয়ানকুং-১ মহাকাশযানে টানা ১২ দিন কাজ করেন। তিনি মহাকাশযানের যাত্রা পর্যবেক্ষণ, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ ও মহাকাশে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পাশাপাশি অন্য নভোচারীদের যত্ন নেন এবং মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস নেন। তিনি চীনের প্রথম মহাশূন্য শিক্ষিকায় পরিণত হন।

নারী নভোচারী প্রসঙ্গ_fororder_as3

এবার শেনচৌ-১৩ নভোযানের যাত্রায় নারী নভোচারীদের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। আগের থিয়ানচৌ-৩ মালবাহী নভোযানে নারীদের কাপড় পাঠানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে এভিয়েশন স্যুট আর সাধারণ কাপড়। তা ছাড়া, স্বাস্থ্যবিধি পণ্য ও ত্বকের যত্নের পণ্যও রয়েছে। ওয়াং ইয়া পিংয়ের জন্য কাপড়চোপড় তাঁর শরীরের সাইজ অনুসারে তৈরি করা হয়। তাই তার কোনো সমস্যা হয়নি। বিদেশি নারী নভোচারীরা বিশেষ ডিজাইনের কাপড় পরার সুযোগ পাননি।

আসলে নারীদের শরীর নমনীয় ও তুলনামূলকভাবে ক্ষীণকায়। তাই মহাশূন্যে তারা তুলনামূলকভাবে সহজে সূক্ষ্ণ কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। গত কয়েক দশকের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, নারী নভোচারীরা কয়েকটি ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় ভালো। নারী নভোচারীরা দ্রুততর সময়ে মহাকাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। তারা সহজে নিঃসঙ্গতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। নারী নভোচারীদের যোগাযোগদক্ষতা পুরুষ নভোচারীদের তুলনায় ভালো।

তা ছাড়া, মহাশূন্যের ওজনহীন অবস্থায় নারীদের শরীরের হরমোন বিপাক পুরুষদের তুলনায় বেশি স্থিতিশীল থাকে। তাই মহাকাশে তাদের অসুখ-বিসুখ কম হয়।

ভবিষ্যতে কেবল চাঁদ নয়, মঙ্গলসহ মহাকাশের আরও অনেক জায়গায় ভ্রমণ করবে পৃথিবীর মানুষ। সেসব অভিযাত্রায় নারী নভোচারীদের আরও বেশি ভূমিকা পালন করতে দেখা যাবে, এ কথা বলাই বাহুল্য।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)