চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা ও বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
2021-11-05 15:56:04

‘চতুর্থ চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা’ অর্থাত্ হোংছিয়াও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান গতকাল বৃহস্পতিবার শাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি আগামি ১০ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিসি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, চীনের প্রেসিডেন্ট, চীনের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান সি চিন পিং ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে ভাষণ দিয়েছেন।

ভাষণে তিনি বলেন,  চীন উন্মুক্তকরণের প্রতিশ্রুতি মেনে চলেছে। গত বছর তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় তাঁর ঘোষিত ধারাবাহিক ব্যবস্থা অনেকটা বাস্তবায়িত হয়েছে। হাইনান অবাধ বাণিজ্য বন্দরের আন্তঃদেশীয় সেবা বাণিজ্যের নেতিবাচক তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, বৈদেশিক পুঁজির প্রবেশ আরও সুবিধাজনক হয়েছে। বাণিজ্যের পরিবেশ আরও উন্নত হয়েছে। এদিকে, চীন-ইউরোপ পুঁজি বিনিয়োগ চুক্তির আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। চীন সবার আগে আঞ্চলিক সার্বিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের সম্পর্কের চুক্তি বা আরসিইপি’র অনুমোদনকাজ সম্পন্ন করেছে। চীন বৈদেশিক পুঁজি প্রবেশের নেতিবাচক তালিকা আরও ছোট করবে এবং টেলিযোগাযোগ ও চিকিত্সাসহ সেবা খাত আরও উন্মুক্ত করবে। চীন বেশি বৈদেশিক পুঁজির আধুনিক উত্পাদন শিল্প, আধুনিক সেবা শিল্প, হাই-টেক ও জ্বালানি সাশ্রয় খাতে বরাদ্দে উত্সাহ দেবে।

 ‘চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা’ হলো বিশ্বের প্রথম আমদানি থিমের ভিত্তিতে চালু করা জাতীয় পর্যায়ের মেলা। এটি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের পরিকল্পিত ও প্রচারিত বৃহদাকার উন্মুক্তকরণের উদ্যোগ।

এর আগে তিনবার এই মেলায় দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট সি একটি উন্মুক্ত বিশ্ব অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনীতির বিশ্বায়নে সমর্থন দেন। তিনি চীনের অবস্থান ও প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করেন এবং ধারাবাহিকভাবে চীনের উন্মুক্তকরণের নতুন ব্যবস্থা ঘোষণা করেন। ‘চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা’ বাইরের বিশ্বের জন্য চীনের উন্মুক্তকরণ পর্যবেক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ জানালা হয়ে উঠেছে।

 

শাংহাইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

শাংহাই চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর। চীনের অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এ শহর। শাংহাইয়ের প্রতীক এর উঁচু উঁচু ভবন, সমৃদ্ধ সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। শাংহাই চীনের প্রথম শহর যেটি বাইরের দুনিয়ার সাথে প্রথম বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। সেই শাংহাই আজ পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক শহরে পরিণত হয়েছে।

 

শাংহাই বৈচিত্র্যময় এক নগর। এখানে ঐতিহ্যবাহী ছোট রাস্তা ও পুরাতন পশ্চিমা স্থাপত্যের নিদর্শন যেমন আছে, তেমনি আছে আধুনিক উঁচু উঁচু ভবন। এখানে আছে চীনা বৈশিষ্ট্যের নানা ধরনের পার্ক। পুরাতন ও নতুনের মিশেলে এ শহর সত্যিই নান্দনিক হয়ে ওঠেছে।

 

শাংহাইয়ে চারটি মৌসুম আছে। বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরত ও শীত। এ শহরে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো সময় বসন্ত ও শরত্কাল। বসন্তকালে শতাধিক ধরনের ফুল ফোটে। উষ্ণ সুর্যালোকে শহরটির প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের শ্রেষ্ঠ সময়। আর শরত্কালে শহরের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। এ তাপমাত্রা ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী।

 

শাংহাইয়ে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই শহরের কেন্দ্র এবং ওয়াই থানের দু’তীরে অবস্থিত। ছেং হুয়াং মিয়াও, ইয়ু ইয়ান এবং নান চিন ওয়াকিং স্ট্রিটে পুরো একটি দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। আরেকটি দিন ছি পাও পুরনো স্ট্রিট, সু চিয়া হুই ও চিং আন মন্দির ঘুরে দেখা যায়। তৃতীয় দিনে বেড়ানো যায় সিন থিয়েন ডি শপিং মল, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সম্মেলনস্থল এবং থিয়েন চি ফাংসহ নানা দর্শনীয় স্থানে। হাতে যদি আরও সময় থাকে, তাহলে জাদুঘরে যাওয়া যায়; করা যায় খানিকটা কেনাকাটা।

এ ছাড়া, শাংহাইয়ের ডিজনিল্যান্ড ও হুয়ানলেকুসহ নানা বিনোদন পার্ক শিশুদের বেড়ানোর শ্রেষ্ঠ জায়গা।

 

 এবারসহ শাংহাইয়ে চারবারের মতো চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা আয়োজিত হয়।

 

প্রথম চীন আর্ন্তজাতিক আমদানি মেলায় বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিআইডিএ), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ উচ্চপ্রযুক্তি উদ্যান কর্তৃপক্ষ, পাট বৈচিত্র্যকরণ উন্নয়নকেন্দ্র (জেডিপিসি), ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশানসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমদানি মেলায় অংশগ্রহণ করে। আমদানি মেলার উদ্বোধনী দিনে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন পরিদর্শন করেন আফগানিস্তানের উপ-বাণিজ্যমন্ত্রী ও সার্কের বাণিজ্য সমিতির মহাসচিবসহ অনেক বিদেশি নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেন এবং ওষুধ, পোশাক, চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য বিভিন্ন রফতানিপণ্যের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যময় সূচিকর্ম, হাতে-বোনা কাপড়, পাটজাত পণ্য দেখে অনেক পছন্দ করেন এবং তাঁরা বাংলাদেশের ওষুধ, পোশাক, মাটির শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

২০১৯ সালের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় অংশ নিয়েছে বিশ্বের ১৫৫টি দেশ ও ২৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রায় চার হাজার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের পক্ষে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড, বেপজাসহ মোট নয়টি সরকারি ও তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশী প্যাভিলিয়নে গতবারের চেয়েও অনেক বেশি ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক মো. আতিক সরকার জানান, মেলার প্রথম আসরে বেশির ভাগ দর্শনার্থী কেবল বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত নেয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। তবে এবারের মেলায় প্রতিদিনই আমাদের প্যাভিলিয়নে বিপুল পরিমাণ দর্শনার্থী ভিড় করছেন। এদের অনেকেই বিস্তারিত জেনে বাংলাদেশে বিনিয়োগে চূড়ান্ত আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, কেউ কেউ এরই মধ্যে শুরু করেছেন নিয়মিত যোগাযোগ।

২০২০ সালের তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায়ও অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। ভিডিও কনফারেন্সে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। চীন সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মেলার বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন। এসময় দূতাবাসের বাণিজ্যিক কাউন্সেলর মোহাম্মদ মনসুর উদ্দীন, সোশ্যাল সেক্রেটারি এবং রাষ্ট্রদূতের দোভাষী জোয়ে জাং উপস্থিত ছিলেন।

চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা ও বাংলাদেশের অংশগ্রহণ_fororder_u=2229974534,2428627333&fm=173&app=25&f=JPEG

এনাম, প্রতি বছর চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণে আমদানি করে। গত বছর চীন ২.৪৮ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আমরা গত কয়েকটি মেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলাপ করেছি; চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দিন দিন জোরদার হচ্ছে। দু’দেশের মধ্যে কীভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো জোরদার করা যায়? আপনি কী মনে করেন?

 

গত জুন মাসে বাংলাদেশকে দেয়া শুল্কমুক্ত সুবিধার ব্যবহার এবং দেশটি থেকে অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা (এফটিএ) নিতে পারলে বাংলাদেশের জন্য চীনের বাজারে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চীনের আমদানি বাজারের কেবল ১ শতাংশ দখল করতে পারলেই বাংলাদেশ বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পারবে। দেশটিতে বর্তমানে ১ বিলিয়ন ডলারের কম মূল্যের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে বাংলাদেশ।