চীনের দুই স্নাতক নারী স্যানিটেশন কর্মী
2021-11-03 11:19:01

বন্ধুরা, আপনারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন যে, একজন বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক কি কখনো স্যানিটেশন কর্মী হিসেবে কাজ করবে কি না?

আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এমন দুজন বোনের গল্প বলব, যারা স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর স্যানিটেশন কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। অনেকেই বুঝতে পারেন না, কেন তারা এমন ক্যারিয়ার বেছে নিলেন? আসলে তাদের মতে, পেশার কোনো তারতম্য নেই। কাজ কাজই। এর উচ্চ বা নিম্ন কোনো পর্যায় নেই। একটি কাজ ভালভাবে করে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ বা শ্রেষ্ঠ কর্মী হওয়া যায়।

২০১৮ সালে ২৯ বছর বয়সী সি লিলি স্যানিটেশন কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কেউ কেউ তখন তার এই ক্যারিয়ার বাছাই নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। তখন তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক কি স্যানিটেশন কর্মী হতে পারে না? কিন্তু তখন তিনি তাঁর স্বজনদের সামনে আত্মবিশ্বাসের সাথে এ কথা বলতে পারেননি। তবে এখন তিনি দৃঢ়ভাবে এ কথা বলতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকও স্যানিটেশন কর্মী হতে পারেন।

আন হুই প্রদেশের হ্য ফেই শহরের  রং হাও পরিবেশ প্রযুক্তি কোম্পানির পুরাতন কর্মী চেন ইং হংয়ের দুই মেয়ে সি লিলি ও সি কুও ছিং এই কোম্পানিতে যোগ দিয়ে তাদের মায়ের মতো স্যানিটেশন কর্মী হন। কোম্পানিটির এই কাজে তাদের মতো তরুণ ও শিক্ষিত মেয়ে প্রায় নেই বললেই চলে, তাই শুরুতে অনেকে অবাক হয়েছিল।

একান্ন বছর বয়সী চেন হং ইং ২০ বছরের মতো স্যানিটেশন কর্মীর কাজ করেন। তার ঘনিষ্ঠ এক খালা এ শহরের প্রথম স্যানিটেশন কর্মীদের মধ্যে অন্যতম। খালার প্রভাবে তিনি এ কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তাই যখন তার মেয়েরাও এ কাজ শুরু করে, তখন তাদের পরিবারে তিন প্রজন্মের স্যানিটেশন কর্মী তৈরি হয়।

২০০৯ সালে চেন হং ইংয়ের মেয়ে সি কুও ছিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর হিসাবরক্ষক হিসেবে একটি কোম্পানিতে কাজ করেন। পরে কোম্পানিটি অন্য একটি জায়গায় স্থানান্তরিত হলে সি কুও ছিং পদত্যাগ করেন। ঠিক ওই সময় চেন হং ইংয়ের কোম্পানি স্যানিটেশন কর্মী নিয়োগ করে। চেন হং ইং বলেন, কোম্পানি যখন কর্মী চায়, তখন তার চাকরি ছিল না। তাই এটি একটি ভাল সুযোগ ছিল।

 

যদিও ছোটবেলা থেকে মায়ের প্রভাবে সি কুও ছিংয়ের মনে স্যানিটেশন কর্মীদের প্রতি কোনরকম বৈষম্য বা ভেদাভেদ ছিল না, তবে তিনি শুরুতে কষ্টকর সময় কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নোংরা কাজ করতে পারি আমি, তবে শরীরের কষ্টের তুলনায় অন্যদের কথা আমার মনে বেশি কষ্ট দেয়। কেউ কেউ আমার শিশুদেরকে বলে, তুমি ভালভাবে লেখাপড়া কর না, কারণ ভবিষ্যতে স্যানিটেশন কর্মী ছাড়া অন্য কোন কাজ পাবে না’। এমন কথা শুনে সি কুও ছিং মনে ব্যথা পান। তবে তার জন্য এ কাজের সুবিধাও কম নয়। বাসার কাছাকাছি এবং সকাল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বাকি সময় নিজের ইচ্ছা মতো কাটাতে পারেন।সি কুও ছিংয়ের ছোট বোন সি লিলি শুরুতে স্যানিটেশন কর্মীর কাজকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি ভাবতেন, রাস্তা পরিষ্কার করা সহজ কাজ, তা সবাই করতে পারে। তবে যখন তিনি বড় বোনের মতো এ কাজ শুরু করেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, তার ধারণা কতটা অপরিণত।

চেন হং ইং হাসিঠাট্টা করে মেয়েদেরকে বলেন, আগে স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য প্রয়োজন একটি কৌশল--‘মাটি খাওয়া’। তবে সি লিলির মতে আজকাল পরিশ্রম ছাড়া এ কাজ ভালভাবে করতে চাইলে কিছু কৌশল ও স্কিল জানতে হয়। দলের প্রধান হিসেবে সি লিলির দায়িত্বের অন্যতম হল রাস্তা পরিদর্শন। কোম্পানির বিশেষ স্যানিটেশন গাড়ি চালিয়ে নির্দিষ্ট রাস্তা পরিদর্শন করেন। সি লিলি ড্রাইভিং লাইসেন্স অর্জন করেছেন। তাছাড়া, এখন বাগান পরিষ্কার করার বিশেষ গাড়ি আছে, দ্রুত লেন পরিষ্কারের বিশেষ গাড়িও আছে। এসব স্যানিটেশন কর্মীদের নিরাপত্তা রক্ষা করে, তবে স্যানিটেশন কর্মীদের গাড়ি ব্যবহারে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হয়।

রাস্তা পরিষ্কারের নিয়ম, পেশাদার প্রযুক্তি ও কৌশল শিখে মাত্র এক মাস পর তার দলের প্রধান হন সি লিলি। কোম্পানির ম্যানেজার বলেন, একজন স্যানিটেশন কর্মী নিয়োগ করা কঠিন নয়, তবে পরিশ্রমী এবং কর্মীদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, ব্যবস্থাপনা করতে পারে-এমন একজন কর্মী নিয়োগ করা কঠিন ব্যাপার।

সি লিলির এখনো মনে আছে, ছোটবেলায় স্কুলের মিটিংয়ে মাকে স্যানিটেশন কর্মীর ইউনিফর্মে দেখে সে অসুখী হতো। তাই মা সবসময় ইউনিফর্ম ছেড়ে স্কুল মিটিংয়ে যেতেন। এখন মেয়ে দুজন মায়ের মতো স্যানিটেশন কর্মী হিসেবে কাজ করেন, তাই তারাও মাকে বুঝেন।

 

এ কাজ শুরুর পর সি লিলিও দায়িত্বের অর্থ বুঝেন । তার সহকর্মীদের বেশিভাগই তার মায়ের মতো বৃদ্ধ।  সকাল ৪-৫ টায়  তার ফোন বেজে ওঠলে তার ভয় হয়। কারণ তিনি চিন্তা করেন, কোনো সহকর্মীর দুর্ঘটনা হলো কি  না? ভোরে রাস্তা পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না, ওই সময় কাজ করা খুব বিপদ। তাই তিনি সবসময় জ্যেষ্ঠ কর্মীদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেন।

 

সি লিলি তার কাজের প্রতি একটি গভীর উপলব্ধি লাভ করেছেন। সহকর্মীদের স্বীকৃতি, কোম্পানি ও সমাজের স্বীকৃতি পান সি লিলি। তার মতে, যদি তার কাজ সমাজের জন্য অর্থবহ হয়, তাহলে এ কাজ মূল্যবান। শুরুতে তার বাবা মেয়ের এ সিদ্ধান্তে দুঃখ পান, তবে এখন তার বাবা গর্ববোধ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের কাজ সবাই যে পারে, এমন নয়’। পাশাপাশি তার স্বামীও তাকে বেশ সমর্থন দেন এবং তার বদলে সে শিশুর যত্ন নেয়।

 

সি লিলির মেয়ে এখন কিন্ডারগার্টেন পড়ছে। তিনি যখন স্কুলে মেয়েকে পিক করেন, তখন স্যানিটেশন কর্মীর ইউনিফর্ম পরেন। তার মেয়ে যদি রাস্তায় কোন আবর্জনা দেখে, তাহলে সবসময় তাকে বল, ‘মা আমরা এ আবর্জনা তুলে নেব’। সি লিলি বলেন, মেয়ে এ কাজকে বুঝে এবং সম্মান করে। পাশাপাশি তার ভাল অভ্যাস ও পরিবেশ সংরক্ষণ ধারণা গড়ে ওঠেছে। এটি সবচেয়ে খুশির ব্যাপার।

 

চীনে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, ৩৬০টি পেশার মধ্যে ৩৬০ জন ১ নম্বর হতে পারে। তার মানে, পেশা কারো উচ্চতা নির্ধিারণ করে না। যে কোন একটি চাকরি করে সবচেয় ভাল পেশাদার হওয়া যায়।

(শিশির/এনাম/রুবি)