১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে ২৭৫৮ নম্বর প্রস্তাবটি পাস হয়। এ প্রস্তাব অনুযায়ী, জাতিসংঘে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সব বৈধ অধিকার পুনরুদ্ধার হয়। অধিবেশনে করতালি ও আনন্দধ্বনি দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকে। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাংবাদিক ইফতিহার আলী বলেন, এ ঘটনা বিশ্বের উপর দীর্ঘ ও গভীর প্রভাব ফেলবে। আমি ৫০ বছরের মতো সাংবাদিকতা করেছি, অতীতে কখনও এমন ঘটনা দেখিনি।
জাতিসংঘে চীনের অধিকার পুনরুদ্ধার মানে বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ মানুষের তথা চীনাদের জাতিসংঘে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব লাভ। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কিমুন বলেন, আকার ও সংগঠনের দিক থেকে দেখলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন যোগ দেয়ার পর জাতিসংঘ একটি বৈশ্বিক সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অধিকার পুনরুদ্ধার চীনা কূটনীতির নতুন অধ্যায় রচনা করে। তখন থেকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ ও সংলাপের গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয় জাতিসংঘ। পাশাপাশি, চীনের বহুপক্ষীয় কুটনীতির মঞ্চও হয়ে ওঠে জাতিসংঘ।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনের সাধারণ বিতর্কে বলেন, চীন সব সময় বিশ্ব শান্তির নির্মাতা, বিশ্ব উন্নয়নে অংশগ্রহণকারী, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার রক্ষক, এবং গণপণ্যের সরবরাহক। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন নিজের উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের জন্য অব্যাহতভাবে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।
জাতিসংঘের মাধ্যমে সারা বিশ্ব চীনের চরিত্র ও অবদান প্রত্যক্ষ করেছে। গেল ৫০ বছরে চীন সব সময় বহুক্ষবাদ রক্ষা করে চলছে। জাতিসংঘ সনদের নীতি মেনে চলছে। জাতিসংঘ-কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক আইনকে ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সৃঙ্খলা রক্ষা করে আসছে, তার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিও পেয়েছে চীন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনের চেয়ারম্যান বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন একটি মহান দেশ এবং তারা অসাধারণ সফলতা অর্জন করেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীন বহুপক্ষবাদ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি এবং জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালনকারী একটি দেশ।
জাতিসংঘের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণকারী দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী চীন । ১৯৯০ সাল থেকে চীনা বাহিনী ২৫টি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোট ৪০ হাজার সৈনিক পাঠিয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত রুশ স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, গেল ৫০ বছরে চীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা কমিটির স্থায়ী সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ সংকট সমাধানে অংশ নিয়ে বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
জাতিসংঘে জাম্বিয়ার সাবেক প্রতিনিধি ভারনন মাওয়াঙ্গা বলেন, আফ্রিকায় চীন শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে সেখানকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণভাবে বিবাদের সমাধান, এবং এতদঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বড় ভূমিকা পালন করেছে।
আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের মহাসচিব বলেন, সারা বিশ্ব বর্তমানে ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত্ আগের যে কোন সময়ের তুলনায় একসাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং অভিন্ন উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা। গত ৫০ বছরে চীনের অংশগ্রহণে জাতিসংঘের কর্তৃত্ব এবং সংকট ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা জোরদার হয়েছে।
জেনেভায় জাতিসংঘ কার্যালয়ের মহাপরিচালক মনে করেন, জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০২০ সালে চীন সময়মতো দারিদ্র্যবিমোচন কর্তব্য শেষ করে, যা জাতিসংঘের ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচির তুলনায় ১০ বছর আগে সম্পন্ন হয়। এটি বৈশ্বিক দারিদ্র্যবিমোচন এবং শান্তিপূর্ণ উন্নয়নে ঐতিহ্যিক অবদান রাখে। চীনের সফলতা বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যায় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর আস্থা বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপসহকারী মহাপরিচালক বলেন, গণস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চীনের অভিজ্ঞতা এবং ঐতিহ্যিক চীনা চিকিত্সা পদ্ধতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সমাজের স্বীকৃতি পেয়েছে।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীন কৌশলগত সফলতা অর্জণ করে এবং বিশ্বের একমাত্র অর্থনৈতিক সত্তা হিসেবে অর্থনীতির বৃদ্ধি বাস্তবায়ন করে। তা বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং নানা দেশের জন্য আস্থা বয়ে এনেছে।
আবহাওয়া সংস্থায়ও চীন একটি গঠনমূলক অংশগ্রহণকারী এবং এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো ও সেবা উন্নয়নে সাহায্য করে আসছে চীন। আবহাওয়া পরিবর্তন মোকাবিলা, দূষণ প্রতিরোধ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চীন। ‘প্রাকৃতিক সভ্যতা’র ধারনাকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করে বিশ্বের জন্য একটি ভাল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার জন্য চীন গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, উন্নয়নশীল দেশের টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নসহ নানা ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতা করতে চায় জাতিসংঘ এবং আগামিতে জাতিসংঘ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হবে। (শিশির/এনাম/রুবি)