কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে, ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগে চীনের বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন উদ্যোগটির আওতায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর ক্ষতি হবে। এখন অনেকেই মহামারীর পর ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায় নতুন সুযোগ সৃষ্টির ওপর নজর রাখছেন।
২০২০ সালে যদিও কোভিড-১৯ মহামারী ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের খানিকটা ক্ষতি করেছে, তবুও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে চীনের অ-আর্থিক সরাসরি বিনিয়োগ হ্রাস পায়নি। ২০২০ সালে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৯ সালের চেয়ে ১৮.৩ শতাংশ বেশি ছিল।
২০১৩ সালে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ গ্রহণের পর, ২০১৪ সালে উদ্যোগের আওতায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৩ সালের ১০ বিলিয়ন থেকে ১২.৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪.৮২ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০২০ সালে বিনিয়োগ ছিল ১৭.৭৯ বিলিয়ন ডলার। উক্ত সাত বছরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় চীনের বিনিয়োগ ছিল মোট ১০৪.৭২ বিলিয়ন ডলার। গড় বার্ষিক বিনিয়োগ ছিল ১৪. ৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে ধীর গতি এসেছে, এ কথা সত্যি। কিন্তু অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পুনরায় দ্রুত শুরুও হয়েছে। এ ছাড়াও, চীন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যেমন, হাঙ্গেরি-সার্বিয়া রেলপথের হাঙ্গেরির অংশ ও পাকিস্তানের কোহারা পানি বিদ্যুত্ কেন্দ্র। গত বছর চীন, জাপান ও ফ্রান্সের সঙ্গে কাতারে প্রথম অ-জীবাশ্ম জ্বালানি চার্জিং স্টেশন নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে। উগান্ডার সঙ্গে ফটোভোলটাইক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চীন।
বস্তুত চীন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মহামারীসহ কোনো কারণেই তা পরিবর্তন হবে না। চীন সৌদি আরব, মিশর, হাঙ্গেরি, কম্বোডিয়া ও ফিলিপিন্সের সঙ্গে বহুপক্ষীয় আর্থিক সহযোগিতা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে চীনের বিনিয়োগ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ শুরু হওয়ার পর চীন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তাও বাড়িয়েছে। কিন্তু শুরু থেকে তিনটি মৌলিক নীতিতে অবিচল ছিল চীন: এক. একসাথে ব্যবসায়, নির্মাণ ও ভোগ করা; বন্ধুত্বপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে অর্থ ব্যবস্থাপনা করা; দুই. বাজারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতা চালানো; এবং তিন. সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উন্নয়নের কৌশল অনুযায়ী পরিকল্পনা করা।
সেজন্য ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ চালু হওয়ার সাত বছরেও কোনো দেশ ঋণ-সংকটে পড়ে যায়নি।
২০১৭ সালে চীন ২৬টি সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায় অর্থ সংগ্রহের নীতি স্বাক্ষর করেছে। ২০১৯ সালে চীনা অর্থ মন্ত্রণালয় ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায় ‘টেকসই ঋণ বিশ্লেষণ কাঠামো’ গড়ে তুলেছে।
অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির মান নিম্ন হওয়ার কারণ হলো খারাপ অবকাঠামো। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর কারণ হলো বিদ্যুতের অভাব। এ কারণে কোনো কোনো দেশে উত্পাদিত শিল্প ও কৃষির মান উন্নত করা কঠিন। এসব দেশকে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করে অর্থনীতির উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা করেছে চীন। সেজন্য ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগে জ্বালানিসম্পদ অবকাঠামো নির্মাণের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বস্তুত, চীন সার্বিকভাবে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের সুযোগ ধরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে জ্বালানিসম্পদ পরিবর্তনও ত্বরান্বিত করে চলেছে। ব্যাপকভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানিসম্পদ উন্নয়ন ও কার্বন নির্গমণ হ্রাস ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে ইতিবাচকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবদান রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে চীন।
কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে সৃষ্ট নতুন পরিবেশে চীন দেশীয় বাজারকে কেন্দ্র করে বিদেশি বাজারের উন্নয়নের নতুন পরিকল্পনা কার্যকর করে। এ ধরণের পরিকল্পনা চীনা অর্থনীতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি বিশ্বের অর্থনীতি উন্নয়নের জন্য নতুন চালিকাশক্তি সৃষ্টি করবে।
চীনের বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি, চীনের আমদানি ও বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এদিকে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ও বিদেশি ব্যবসায়ীদের চীনে সরাসরি বিনিয়োগ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে চীনের বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ ছিল ১৩২.৯৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৩.৩ শতাংশ বেশি। বিদেশি ব্যবসায়ীদের চীনে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৪৪.৪৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৪.৫ শতাংশ বেশি। গত বছরে চীনে বিদেশি ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিমাণ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ছিল্ চীনের উন্মুক্তকরণ অব্যাহতভাবে উন্নত হচ্ছে। চীনের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক যোগাযোগ আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ হলো চীনের দেশি-বিদেশি বাজার একসঙ্গে উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। উদ্যোগটির আওতায় চীন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতায় ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করেছে। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে চীনের আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পায় ১ শতাংশ। এর মধ্যে আসিয়ানের দশটি সদস্যদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরে আসিয়ানের দশটি সদস্যদেশ চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আঞ্চলিক সার্বিক অর্থনৈতিক অংশীদারি সম্পর্কের চুক্তি (আরসিইপি) স্বাক্ষর করেছে। এটি সমস্ত অঞ্চল ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনীতি উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, ডিজিটাইজিং ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কোভিড-১৯ মহামারীকালে, দেশে-দেশে, প্রতিষ্ঠানে-প্রতিষ্ঠানে, মানুষে-মানুষে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিময়ের পদ্ধতি পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো অনলাইন বাণিজ্যের দ্রুত উন্নয়ন। ডিজিটাল পরিষেবা দ্রুত উন্নত হচ্ছে।
‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে চীন ১৬টি দেশের সঙ্গে ডিজিটাল অর্থনৈতিক সহযোগিতার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে এবং ২২টি দেশের সঙ্গে ‘রেশমপথ ই-কমার্স’ সহযোগিতা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছে। গত বছরে চীনা চিকিত্সা বিশেষজ্ঞরা অনলাইনে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর চিকিত্সাকর্মীদের সঙ্গে মহামারী প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন।
চীনের ডিজিটাল অর্থনীতির জিডিপি’তে অবদান বছর বছর বাড়ছে। ডিজিটাল অর্থনীতির উন্নয়নের বিরাট ঐতিহাসিক সুযোগও রয়েছে। চীন সার্বিকভাবে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায় এক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করছে।
চীন বিশ্বাস করে, ৫জি টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নির্মাণের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ডিজিটাল অর্থনীতি আরও উন্নত হবে।