পটুয়াখালীতে পায়রা নদীর ওপর নির্মিত বহু প্রতীক্ষিত পায়রা সেতু চালু হয়েছে। রোবাবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরপরই সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এর ফলে ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে ফেরীবিহীন যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হলো। আগামী বছর পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে সমুদ্র-শহর কুয়াকাটা যেতে আর কোনো ফেরি পার হতে হবে না। সেতুটি চালু হওয়ার ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হবে, আরও গতিশীল হবে পায়রা বন্দরের কার্যক্রম। দেশের সার্বিক যোগাযোগ খাতের উন্নয়নেও পায়রা সেতু একটি মাইলফলক।
একসময় সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা যেতে ১০টি ফেরি পার হতে হতো। এতে করে সময় ও অর্থের অপচয় হতো। যোগাযোগের অসুবিধার কারণে দেশের দক্ষিণ জনপদে অর্থনৈতিক অগ্রগতিও বিঘ্নিত হচ্ছিল।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ৮ মে একনেকে পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্প পাস হয়। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
১ হাজার ৪৭০ মিটার দীর্ঘ এবং ১৯.৭৬ মিটার প্রস্থের চার লেনের সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। সেতুটির ৮২ ভাগ অর্থায়ন করেছে কুয়েত ফান্ড ফর ইকনোমিক ডেভেলপমেন্ট। বাকিটা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। দৃষ্টিনন্দন সেতুটি নির্মাণ করেছে চীনের লংচিয়ান রোডস এন্ড ব্রিজ কোম্পানি।
নির্মাণ প্রযুক্তিতেও সেতুটি অনন্য। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুর মতোই এটি নির্মাণ করা হয়েছে ‘এক্সটাডোজড ক্যাবল স্টেইড’ প্রযুক্তিতে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সেতুটি তারে ঝুলে রয়েছে। নদীর পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে সেতুর মাঝখানে রয়েছে একটিমাত্র পিয়ার। ১৩০ মিটার গভীর পাইলিং করে বসানো হয়েছে পিয়ারটি।
জলযান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে জলপ্রবাহ থেকে ১৮.৩০ মিটার উঁচুতে। সেতুতে অতিরিক্ত ভারি যানবাহন উঠলে আপনি আপনি বেজে উঠবে সতর্ক সংকেত। আর ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে ব্যবহার করা হয়েছে ব্রিজ হেলথ মনিটর।
স্বপ্নের এ সেতুটি চালু হওয়ায় আনন্দের বন্যা বইছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে। সেতুটি উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চল সবসময় অবহেলিত ছিল ঊল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে- সারাদেশে গড়ে তুলছে সড়ক নেটওয়ার্ক। এ থেকে বাদ পড়েনি দক্ষিণাঞ্চলও। প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। যোগযোগ ব্যবস্থাসহ দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির কারণে এখন বিশ্বে কেউ আর বাংলাদেশকে হেয় করতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী কিছুটা আবগে তাড়িত হয়ে বলেন, নিজে সশরীরের উপস্থিত থেকে সেতুটি উদ্বোধন করতে পারলে, সেতুর ওপর একটু হাটতে পারলে তার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু করোনা কারণে এখন একরকম বন্দিজীবন যাপন করতে হচ্ছে বলে জানান শেখ হাসিনা। পায়রা নদীতে স্পিডবোট চড়ার স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন- অচিরেই তিনি গাড়িতে করে এ সেতু দিয়ে ভ্রমণ করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর মতোই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আবেগ জড়িয়ে স্বপ্নের সেতুটির সঙ্গে। ওই অঞ্চলসহ দেশের মানুষও আশা করে এতে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যোগাযোগ সহজ হবে এবং পায়রা বন্দর একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে।
সংশ্লিষ্ট মহল সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দেশের অন্যতম এ সেতুটি রক্ষাণবেক্ষণ, পরিচালন ও এটিকেও নিরাপদ রাখতে দায়িত্ব পালন করবেন বলে আশা করে দেশবাসী।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।