চীনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন অনলাইনে জনপ্রিয় ব্লগার
2021-10-22 15:36:33

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এপিপি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনলাইনে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার সাথে সাথে ‘বিলিবিলি’সহ আরও অনেক এপিপি থেকে পেশাগত জ্ঞান শেখা যায়। বিভিন্ন মহলের ব্যক্তিরা অনলাইনে নিজেদের অ্যাকাউন্ট খুলে নিজেদের পেশাগত জ্ঞান সবার জন্য সহজ ভাষায় তুলে ধরছেন। এমন ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন চীনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অধ্যাপকরাও। বিলিবিলি এপিপিতে চীনের থুংজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র ও পৃথিবী একাডেমির অধ্যাপক, রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমির সহযোগী অধ্যাপক এবং ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান একাডেমির অধ্যাপকরা জ্ঞান বিতরণ করছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা বিলিবিলিতে বিভিন্ন অধ্যাপকের অনলাইনে ক্লাস নেওয়া এবং তাঁরা কেন অনলাইন ক্লাস নিচ্ছেন—সে সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

চীনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন অনলাইনে জনপ্রিয় ব্লগার_fororder_wpx

বিলিবিলি এপিপি’র সূত্রে জানা গেছে, তাদের প্ল্যাটফর্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়মিত অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। তাদের মধ্যে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির একাডেমিশিয়ান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকসহ সুপরিচিত পণ্ডিত ও শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৩০০ জন। তাঁদের গবেষণা ও পড়াশোনার বিষয়ও শতাধিক ধরনের।

ইন্টারনেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা সংস্থার অধ্যাপক ও পণ্ডিতরা অনলাইনে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারছেন, যা সবার জন্য কল্যাণকর। রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ছাই তান জুন নিজের বাড়িতে বিভিন্ন অনলাইন ক্লাস রেকর্ড করেন। গত কয়েক বছর ধরেই খেয়াল করছিলেন যে, কোনো প্রশ্নের জবাব খুঁজতে শিক্ষার্থীরা প্রথমে ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হয়। বই থেকে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে পরে। তখন তিনি অবাক হয়ে যান। তিনি ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন যে, নতুন প্রজন্মের বাচ্চারা অতীতের ছাত্রছাত্রীদের মতো নয়। এ প্রজন্মের যুবকদের জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি পুরোপুরি বদলে গেছে। এখন নতুন যুগ ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে শিক্ষকদের পড়াশোনার পদ্ধতিও পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

চীনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন অনলাইনে জনপ্রিয় ব্লগার

শানতুং অর্থ ও ফাইনান্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সুং হাও ভিডিও ক্লাস নিচ্ছেন প্রায় ৮ বছর ধরে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, একবার শিক্ষার্থীরা তাকে বলল যে, রৈখিক বীজগণিত অনেক কঠিন, তারা ক্লাসের লেকচারের অনেককিছুই তাত্ক্ষণিকভাবে বুঝতে পারে না। তাই সুংকে ক্লাসের বিষয়বস্তু রেকর্ড করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শেয়ার করার অনুরোধ করে শিক্ষার্থীরা। তো, শুরুর দিকে তিনি কেবল রেকর্ডার ব্যবহার করে অডিও-লেকচার তৈরি করতেন। পরে ডিভি আর ক্যামরা নিয়ে ভিডিও-ক্লাস শুট করতে শুরু করেন। তখন থেকে ধীরে ধীরে ভিডিও এডিটিংয়ের কাজটাও তিনি শিখে ফেলেন।

ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ একাডেমির অধ্যাপক চাও বিন অনলাইনে ‘ল্যান্ডস্কেপ বাস্তুশাস্ত্র’ ভিডিও পোস্ট করেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা-ওয়েবসাইট ব্যবহার করেছেন। তিনি মনে করেন, নতুন মিডিয়া যুগে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পদ্ধতিও উন্নত করা প্রয়োজন। গতানুগতিক ক্লাস-শিক্ষার সঙ্গে  নতুন পদ্ধতি বা নতুন মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মজার বিষয় ও পেশাগত জ্ঞান মিশ্রিত করা প্রয়োজন। এতে লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদে আগ্রহ বাড়বে।

শিক্ষক ছাই নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা সম্পর্কে বলেন, শিক্ষকদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি যুগের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন করতে হবে। অতীতে শিক্ষার্থীরা কেবল নিজেদের শিক্ষকদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করতো। আর নতুন যুগে শিক্ষার্থীরা ক্লাস থেকে যথেষ্ঠ জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থ হলে অনলাইনে আরও ভালো শিক্ষকের লেকচার শুনতে পারে। তাই শিক্ষকদের উচিত এমন পদ্ধতিতে ক্লাসে শিক্ষাদান করা যাতে শিক্ষার্থীরা তাতে আকৃষ্ট হয়। অতীতের পড়াশোনার সঙ্গে বর্তমানের পড়াশোনার তুলনা করে শিক্ষক ছাই বলেন, বর্তমানে শিক্ষকদেরকে নিজেদের ধারণা অনুসারে ক্লাস নিলে চলবে না, বরং শিক্ষার্থীদের চাহিদা বিবেচনা করে ক্লাসের সময়সূচি ও বিষয় ঠিক করতে হবে। অতীতে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে প্রশ্ন করতে ভয় পেতো। এখন অনলাইনে ভিডিও-ক্লাসে তারা সাহসের সাথে প্রশ্ন করে থাকে। আমি এমন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দিই।

বিলিবিলি এপিপির ওয়েসবাইটে অধ্যাপক সুং হাও’র ‘উন্নত গণিত’ ক্লাসের প্রচারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, চীনে প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পর্যায়ে প্রায় ২ কোটি শিক্ষার্থী থাকে। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশকে উন্নত গণিত শিখতে হয়। তাই এ ক্লাস কতো গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে, কিছু কিছু শিক্ষার্থীর জন্য উন্নত গণিত অত্যন্ত কঠিন ও বিরক্তিকর ব্যাপার। আমি আমার ভিডিও ক্লাসের মাধ্যমে গণিত বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছি এবং তা কার্যকরভাবে অনেক শিক্ষার্থীকে সাহায্য করেছে। সেটি বেশ তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার।

অধ্যাপক ওয়াং পিন সিয়ান বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট জ্ঞানের সম্প্রচারের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি সবসময় বলেন, বিজ্ঞানের জ্ঞান সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করা উচিত। এতে আরো বেশি মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আগ্রহী হবে। অনলাইনে শর্ট ভিডিও শুটিং করার মাধ্যমে বিজ্ঞানের অনেক বিষয় সহজভাবে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা যায়। আমি এ কাজ করতে গিয়ে নিজেও কিছু নতুন প্রযুক্তি শিখেছি।

ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চাও বিন বলেন, বাস্তুশাস্ত্রসম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন আসলে খুব কঠিন নয়, তবে এর নাম শুনেই অনেকে একে কঠিন মনে করেন। তাই বাস্তুশাস্ত্র নিয়ে ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করেন তিনি। এ সম্পর্কে চাও বলেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জ্ঞানের সমন্বয়ে একজন মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। ছোট ছোট ভিডিওর মাধ্যমে সহজ ভাষায় জ্ঞান ছড়িয়ে দিলে তা সহজে মানুষ আয়ত্ব করতে পারে।

অনলাইন ক্লাসের আরেকটি পরিবর্তন চাওয়ের জন্য আকর্ষণীয়। অনলাইন ও অফলাইনের সমন্বয়ে শিক্ষাদান শিক্ষকদের জন্য নতুন। অধ্যাপক চাও ক্লাসের মূল বিষয় নিয়ে ভিন্ন মহলের শিক্ষার্থীদের মতামত ও প্রশ্ন সংগ্রহ করেন এবং একই সময়ে অনলাইনে তাদের চিন্তাভাবনা বিনিময় করেন।

শিক্ষক ছাই তান জুন চীনা ভাষার ক্লাস নিয়ে থাকেন। যখন অনলাইনের ক্লাস শুরু করেন, তখন তিনি শুরুর দিকে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতেন, যাতে কমপক্ষে ২ মিনিট লাগত। তখন শিক্ষার্থীরা অনলাইনে তাকে ম্যাসেজ দিয়ে জানায়, তারা মনে করে এমন সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কম সময় নেওয়া উচিত। তখন শিক্ষক ছাই আরও কম কথা বলে মূল ক্লাস শুরু করতে শুরু করেন। তখন তার ভিডিওয়ের ক্লিক সংখ্যাও অনেক বেড়ে যায়। এ সম্পর্কে ছাই বলেন, যদি একটি ভিডিওর ক্লিকের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হয়, তবে তার মানে বেইজিংয়ের বার্ডনেস্ট স্টেডিয়ামের আসনের সংখ্যার সমান সেটি। অন্যভাবে বললে, সেটি হবে বিশাল একটি ক্লাসরুম। সবসময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরামর্শ শুনে তার ক্লাসের মান উন্নয়নে সচেষ্টা থাকেন তিনি।

ক্লাসে আরও বেশি শিক্ষার্থী আকর্ষণে শিক্ষক সুং সবসময় মজার কথা দিয়ে ক্লাস শুরু করেন এবং কৌতুকের মাধ্যমে ক্লাসে জ্ঞান বিতরণ ধরেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, অনলাইনের ব্লগার হিসেবে আমি নিজের পড়াশোনার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি শেয়ার করি। তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরাও জানতে পারবে লেখাপড়ার তাত্পর্য ও আকর্ষণীয় বিষয় কী। শিক্ষক সুংও গ্রামে বড় হয়েছেন, ধাপে ধাপে পড়াশোনার মাধ্যমে তিনি নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। শিক্ষক সুংয়ের মেজর গণিত। তিনি গণিত সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। টানা ৮ বছরের প্রচেষ্টা ও অনুশীলনে তিনি গণিত পড়ানোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যময় পদ্ধতি গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার পড়ানোর পদ্ধতি পছন্দ করে।  ভবিষ্যতে তিনি উচ্চবিদ্যালয়, মাধ্যমিক স্কুল ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য মজার মজার গণিতবিষয়ক ভিডিও রেকর্ড করবেন বলে জানালেন।

এ কয়েকজন অধ্যাপকের ফিল্ড ভিন্ন, তবে তারা একই ধরনের কাজ করছেন: জটিল জ্ঞান সহজ ভাষায় ভিডিও-রেকর্ড করে অনলাইনে প্রচার করছেন। এ সম্পর্কে ল্যান্ডস্কেপবিষয়ক অধ্যাপক চাও বলেন, প্রকৃতি বা বিজ্ঞানবিষয়ক পুঁথিগত বিদ্যা  অনেকের জন্য বোঝা কঠিন। আমি ইংরেজি থেকে তা চীনা ভাষায় আক্ষরিক অনুবাদ করেছি। এভাবে আরো বেশি শিক্ষার্থী এ ধরনের কঠিন বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাবে। এভাবে বিজ্ঞান-গবেষণাপত্র ও থিসিসও সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন বিষয় আর থাকবে না। শিক্ষকের কাজ শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, বরং প্রতিটি জ্ঞান সম্পর্কে নিজের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও যোগ করতে হবে। আমাদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে চীনা ভাষায়ও বিভিন্ন কঠিন বিষয় ও মূল্যবোধ প্রচার করা সম্ভব। সেটিই আমাদের মূল কাজ ও দায়িত্ব।

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)