যদিও জীবন আমাদের জন্য কষ্টকর, তবুও আমরা কখনওই জীবন সম্বন্ধে হতাশ হবো না
2021-09-30 16:31:38

যদিও জীবন আমাদের জন্য কষ্টকর, তবুও আমরা কখনওই জীবন সম্বন্ধে হতাশ হবো না

যদিও জীবন আমাদের জন্য কষ্টকর, তবুও আমরা কখনওই জীবন সম্বন্ধে হতাশ হবো না_fororder_hong1

 

হুং চান হুই, তিনি ২০০৫ সালে ‘চীনকে মুগ্ধ করা ব্যক্তির’ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তিনি ১৩ বছর বয়সে পুরো পরিবারের বোঝা কাঁধে নেন। এখন তাঁর অবস্থা কেমন? তাঁর জীবনে কি কি পরিবর্তন ঘটেছে? আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদেরকে তাঁর মনোমুগ্ধকর গল্প শোনাবো।

 

তাঁর জীবনের শুরু থেকে বিভিন্ন ধরনের দুঃখ ও দুর্যোগ পিছু নেয়। যখন বাবা অসুস্থ হন, তখন তিনি পুরো পরিবারের দেখাশোনা করা শুরু করেন। যখন তাঁর মা পরিবার ছেড়ে চলে যান, তখন তিনি পরিবারের সব বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেন। বাসায় ছোট বোনের যত্ন নেওয়ার মানুষ ছিল না, তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছোট বোনকে নিয়ে যেতেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর। এই বয়সে ছোট বোনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার ব্যাপারটা অসংখ্য চীনাদেরকে মুগ্ধ করেছিল। তারপর ১৬ বছর পার হয়েছে। হুং চান হুই ও তাঁর ছোট বোন কেমন আছে এখন?

 

১৯৮২ সালের জুন মাসের কোনও এক দিন হুং চান হুই মধ্য চীনের হ্যনান প্রদেশের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ধনী ছিল না। তবে, বাবা মা’র চেষ্টায় তাঁদের জীবন মোটামুটি ভালোই চলছিল। তবে সব কিছু ১৯৯৪ সালে  সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। হুং চান হুই-এর বাবা সে বছর হঠাত্ মনো-স্নায়ু রোগে আক্রান্ত হন। এমন অবস্থায় তাঁর মাও অসুস্থ হন। তাঁর এক ছোট বোন আকস্মিক ঘটনায় মারা যায়। পরিবার খুব দরিদ্র অবস্থায় পড়ে। সেই বছরকে বলা যায় হুং চান হুই-এর জীবনের কঠিন সময়। বাবা’র মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ার পর এক বছর বয়সী ছোট বোন মারা যায়। তখন তাঁর বাবাও খুব অনুতপ্ত হন। একদিন তাঁর বাবা বাইরে থেকে একটি মেয়েকে কুড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। সেই ছোট মেয়েটিই হলো হুং চাং হুই-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া সেই ছোট বোন!

 

নিজের মেয়ে মারা গেছে, হুং-এর মা কিন্তু এই ব্যাপারটি ভুলতে পারেন না। আর হুং-এর বাবার মানসিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে। তিনি স্ত্রীকে মারধোর করেন। ১৯৯৫ সালের অগাস্ট মাসে, হুং-এর মা বাড়িঘর পরিষ্কার করেন, সন্তানদের জন্য শেষ খাবার রান্না করেন। তারপর হুং আর নিজের মাকে দেখতে পান নি। হুং তখন ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর। সারা দিন মাকে খুঁজেছেন; কিন্তু কোথাও পান নি। হুং দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন: মা, তুমি কোথায় গেছো? ফিরে আসো। কিন্তু তাঁর মা আর ফিরে আসেন নি। হুং সেই রাত ঘুমাতেও পারেন নি। এই ১৩ বছরের কিশোর যেন সেই এক রাতে হঠাত্ বড় হয়ে যায়। হুং বুঝতে পারে যে, এখন এই পরিবার শুধু তাঁর ওপর নির্ভর করে চলবে, তার বাবার উপর নয়।

 

হুং-এর বাসা গ্রামাঞ্চলে। স্কুলের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। স্কুলে গেলে ছোট বোনের যত্ন নেওয়া সম্ভব না। তাই হুং ছোট বোনকে প্রতিবেশীর বাসায় রেখে যেতেন। রাতে স্কুল থেকে ফিরে আসার পর তাকে আবার বাসায় নিয়ে আসতেন। এসব কাজ একটি ১৩ বছরের কিশোরের জন্য সহজ কাজ নয়। আর ছোট বোনের জন্য দুধ কিনতে হয়। তাই হুং একদিকে বই পড়েন, অন্যদিকে রাস্তার পাশে ছোট ব্যবসা শুরু করেন। হুং ডিম ও আইসক্রিম বিক্রি করেন, এভাবে কিছু টাকা আয় হলে ছোট বোনের জন্য দুধ কিনতে পারেন।

 

এমন কঠোর অবস্থার মধ্যও হুং ক্লাসের মেধাবী ছাত্র। ছোট বোন তাঁর আন্তরিক যত্নে বড় হতে থাকে। উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় হুং ভালো ফলাফল নিয়ে স্থানীয় ভালো উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তবে এই সুখবরের সঙ্গে আসে একটি সমস্যা। হুং আর ছোট বোনের ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করাও একটি সমস্যা। এ অবস্থায় স্কুলে লেখাপড়া করে ফি পাওয়ার চিন্তা করেন হুং। এদিকে কয়েক বছর ধরে আত্মীয় ও প্রতিবেশীর সাহায্যে হুং-এর বাবার মানসিক অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে; জমিতে কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করেন তিনি। বাবা আসলে হুং-এর কাছে খুব দুঃখ প্রকাশ করেন। বাবা বাসার শস্য বিক্রি করে ৫০ ইউয়ান হুংকে দেন। তখন ১৬ বছর বয়সী হুং গ্রীষ্মকালের ছুটিতে কিছু কাজ করা শুরু করেন। এই গ্রীষ্মকালের ছুটিতে হুং ৬শ’ ইউয়ান উপার্জন করতে সক্ষম হন। এরপর শিক্ষক ও আত্মীয়দের সাহায্যে হুং অবশেষে জেলার উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। বাবার আবারও রোগাক্রান্ত হওয়ার আশংকায় হুং স্কুলের কাছে একটি ছোট ঘর ভাড়া করে ছোট বোনকে নিয়ে বাস করতে থাকেন। তবে এমন শান্ত জীবন বেশিদিন ছিল না। দুর্যোগ আবারও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

 

উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছর তাঁর বাবার মানসিক অবস্থা আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়ে ওঠে। কোনও উপায় না দেখে  বাবাকে মানসিক রোগের হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তবে হাসপাতালে ভর্তি করতেও টাকা লাগে। এভাবে তার ওপর চাপ আরও বেড়ে যায়। জীবনের চাপে হুং বাধ্য হয়ে স্কুলের লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাসায় ফিরে যান। কারণ বাসায় তাঁর প্রয়োজন অনেক বেশি।

 

স্কুল ছেড়ে দিয়ে হুং কৃষিজমি চাষ করেন, সেই সঙ্গে বাবা ও ছোট বোনের যত্ন নেন। সময় পেলে কিছু ব্যবসা করেন। এভাবে এক বছরে ৭ হাজার ইউয়ান আয় করেন তিনি। তখন গ্রামের জীবন খারাপ ছিল না। কিন্তু জীবনের চিন্তা কম হলেও হুং শুধু স্কুলে ফিরে যেতে চাইতেন।

 

২০০০ সালে হুং-এর বয়স হয় ১৮ বছর। তখন তাঁর ছোট বোনও কিছুটা বড় হয়। বাবার রোগও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ সময়টি ছিল হুং-এর জীবনের আরেকটি সন্ধিক্ষণ। তখন স্থানীয় সরকার দ্বিতীয় উচ্চবিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষকের সাহায্যে হুং আবারও স্কুলে ভর্তি হন।

 

তবে, এই সুন্দর জীবন শুধু এক বছর স্থায়ী হয়। হুং-এর বাবার অবস্থা আবারও খারাপ হয়। তবে এবার হুং লেখাপড়া ছেড়ে দেন নি। নিজের নিরলস চেষ্টার পর হুং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। তিনি ভালো ফলাফল নিয়ে হুনান হুয়াই হুয়া ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার ফি যোগাড় করার জন্য তিনি আবারও গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কাজ করেন।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেমিস্টারের ছুটিতে হুং বাসায় ফিরে দেখতে পান যে, ছোট বোন স্কুলে যায় নি, বাসায় রয়েছে। হুং খুব মর্মাহত হন, তিনি জানেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষের জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ! তাই তিনি একটি বড় সিদ্ধান্ত নেন, ছোট বোনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, ছোট বোনকে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার পর হুং প্রথমে ছোট বোনের উপযোগী স্কুলের ব্যবস্থা করেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হুং-এর পরিবারের অবস্থা শুনে হুংকে বিশেষ একটি আলাদা হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দেন, যাতে তিনি ছোট বোনকে নিয়ে থাকতে পারেন।

যদিও জীবন আমাদের জন্য কষ্টকর, তবুও আমরা কখনওই জীবন সম্বন্ধে হতাশ হবো না_fororder_hong3

এভাবে হুং ও তাঁর ছোট বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তাঁর জীবনের ওপর সমাজের বিভিন্ন মহলও মনোযোগ দেয়। অনেক ভালো মানুষ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু হুং তা গ্রহণ করেন না। হুং মনে করেন, তিনি তরুণ মানুষ, টাকা উপার্জনের জন্য পরিশ্রম করতে পারবেন।

 

এভাবে হুং নিজের চেষ্টায় ২০১১ সালে মাস্টার্স ডিগ্রিও অর্জন করেন। স্নাতক পাসের পর হুং আবারও নিজের জন্মস্থানের স্কুলে ফিরে যান এবং শিক্ষাদানের কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক গেমসের সময় হুং অলিম্পিক গেমসের মশালধারীর মর্যাদা লাভ করেন।

 

এখন হুং এবং তাঁর পরিবারের অবস্থা কেমন? হুং ২০১৬ সালে হুনান প্রদেশের তথ্য ইন্সটিটিউটের প্রধান হন। এই কাজ তিনি বহু বছর ধরে করছেন। তিনি অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাই হুং সিদ্ধান্ত নেন যে, নিজেই শিক্ষা খাতে কিছু কাজ করবেন। অবশ্য টাকা উপার্জনের জন্য নয়, বরং শিক্ষা খাতের উন্নতির জন্য। দেশে শিক্ষার বিকাশে তিনি অবদান রাখতে চান। তিনি নিজের জীবনকাহিনী নিয়ে একটি বই রচনা করেন। তিনি নিজের গল্পের মাধ্যমে সবাইকে উত্সাহ দিতে চান।

 

এরপর হুং নিজের প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুর দিকে তা অনেক কঠিন ছিল। তবে নিজের শিক্ষা খাতের অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে হুং সফলভাবে ছাংসা সিয়াং হুয়া পেশাদার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এখানে প্রধানত শিক্ষার্থীদের পেশাদার সামর্থ্য শেখানো হয়। হুং শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শেখানোর জন্য কিছু শিক্ষা বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানান।

 

সেই সঙ্গে হুং নিজের বিদ্যালয়ে ‘লাল হৃদয় তহবিল’ স্থাপন করেন। তিনি আশা করেন, সেই তহবিলের অর্থ দিয়ে যারা জীবনে কঠিনতার মুখোমুখি হয়, তাদেরকে সাহায্য করা যাবে।

হুং-এর ছোট বোনও হুং-এর উত্সাহে অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছে। তার ছোট বোন বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হতে পেরেছে, আর স্নাতক পাসের পর তিনি একজন শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এখন হুং-এর ছোট বোন একটি কিন্ডার্গাটেনে শিক্ষকতা করছেন।

 

বলা যায়, হুং-এর পরিবারটি নিজের চেষ্টায় চীনের শিক্ষা খাতে অবদান রেখেছে। হুং শুধু নিজের জীবনকে পরিবর্তন করেননি, বরং নানা সমস্যার মধ্যেও পুরো পরিবারের ভাগ্যকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। হুং কখনওই অনুতপ্ত বোধ করেন না। পরিবার হলো তাঁর জীবনের নির্ভরতার জায়গা। আর তিনি পরিবারের দায়িত্ব বহন করেন। কারণ, তিনিই হলেন এই পরিবারের কেন্দ্র।

 

হুং বলেন, যদিও জীবন আমাদেরকে নানা কষ্ট দিয়েছে, তবুও আমরা কখনওই জীবন সম্বন্ধে আশা ছেড়ে দেবো না।

১৬ বছর পার হয়ে গেছে, হুং ইতোমধ্যে বিয়ে করেছেন এবং তিনি নিজেও বাবা হয়েছেন। আর তিনি নিজের স্বপ্নের শিক্ষকতা পেশায় জড়িত রয়েছেন। তিনি এখন দেশের শিক্ষা খাত উন্নয়নের চেষ্টা করছেন। তিনি আরও গরিব শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)