১৪০টিরও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল দাদা’
2021-09-30 16:24:58

১৪০টিরও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল দাদা’

 

১৪০টিরও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল দাদা’_fororder_zhang3

 

‘প্রিন্সিপাল দাদা, ভয় পাবেন না, আমি অনেক ভালোভাবে সাদা চুল তুলতে পারি।’ সম্প্রতি হ্যনান থাই খাং জেলার একটি ছয় বছরের মেয়ে ‘প্রিন্সিপাল দাদার জন্য সাদা চুল তোলার ভিডিও অসংখ্য নেটিজেনকে মুগ্ধ করেছে। অনেক নেটিজেন কমেন্টসে প্রশংসা করে লিখেছে যে, এই প্রিন্সিপাল এত সাদামাটা। প্রিন্সিপাল অনেক আন্তরিক ও আপন।

সবার সেই ‘প্রিন্সিপাল দাদা’ হলেন চীনের হ্যনান প্রদেশের থাই খাং জেলার ছিং জি থানার আর লাং মিয়াও প্রাথমিক স্কুলের প্রধান চাং ভেং ছেং। তাঁর সাদা চুল তোলা মেয়েটি হল এই স্কুলেরই প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী।

 

কিন্তু নেটিজেন ও সাংবাদিকদের অবাক করার বিষয়টি হলো, চুল সাদা এই প্রিন্সিপাল আসলে ৮০ দশকে জন্ম নেওয়া মানুষ। তাঁর বয়স প্রায় ৪০। তাঁর পরিচালিত এই প্রাথমিক স্কুলটি বাতিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি এই তিন বছরে ১৪০টিরও বেশি শিশুর যত্ন নিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন এবং তিনি চলে যান নি। তিনি সাংবাদিককে বলেন, আমি যেহেতু এই পেশা বাছাই করেছি, তাহলে আমি নিশ্চয়ই ভালোভাবে একাজ করবো। গ্রামের শিশুদের বাবা-মা অনেকেই বড় শহরে গিয়ে চাকরি করে, এসব শিশুদের জন্য সমাজের ভালোবাসা খুব প্রয়োজন। এক বছর শুধু একবার বাবা মা’র সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তাই তারা পরিবার ও ভালোবাসা পেতে আগ্রহী থাকে। আমার কাছে তাদের যত্ন নেওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে হয়।

 

আর লাং মিয়াও স্কুলের শিক্ষক থিয়ান সেদিন চুল তোলার মুহূর্তের কথা স্মরণ করে বলেন, তিনি দেখেছেন যে এই ছোট শিশু প্রিন্সিপাল চাং-এর কাছে গিয়ে, কোনো কথা বলে না, তবে সরাসরি নিজের হাত তুলে প্রিন্সিপাল চাং-এর হাতের সঙ্গে নিজের হাতের মাপ পরীক্ষা করে।

আর কিছুক্ষণ পর ছোট মেয়েটি প্রিন্সিপাল চাং-এর চুল দেখে বলে যে, প্রিন্সিপাল দাদা, আমি তোমার সাদা চুল তুলে দেই?

 

শিক্ষক থিয়ান বলেন, এ মুহূর্তটি আসলে খুব উষ্ণ। তাই তিনি মোবাইলফোন দিয়ে তা রেকর্ড করে ইন্টারনেটে পোস্ট করেন। তবে তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি যে, এত নেটিজেন এই ভিডিও’র প্রশংসা করবে।

শিক্ষক থিয়ান বলেন, প্রতিবার দুপুরের খাবার শেষে প্রিন্সিপাল চাং প্রত্যেক ক্লাসে গিয়ে শিশুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটান। তিনি বলেন, শিশুদের চোখে, প্রিন্সিপাল চাং যেন নিজের বাবা’র মতো আপন। আসলে সাধারণ জীবনে অন্য শিশুরাও প্রিন্সিপাল চাং-এর সাদা চুল তুলে দেয়।

যখন সাংবাদিক প্রিন্সিপাল চাং-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে যান, তখন অবাক হন। কারণ সাদা চুলের এই প্রিন্সিপাল আসলে ১৯৮০ সালের পরে জন্ম নেওয়া মানুষ। শিশুদের মুখের ‘প্রিন্সিপাল চাং’ ১৯৮২ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি গ্রামে শিক্ষাদানের কাজ করেছেন ১১ বছর ধরে।

১৪০টিরও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল দাদা’_fororder_zhang1

সব চুল সাদা, স্কিন কালো এবং অনেক ভাঁজ। কথা বলতে একটু লজ্জা পান- এটাই হলো প্রিন্সিপাল চাং ভেং ছেংয়ের চরিত্র। যখন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, কেন এত তরুণ বয়সে চুল সাদা হলো? তখন চাং সরাসরি উত্তর দেন নি, বরং শুধু হাসতে হাসতে বলেন, হয়তো বেশি চিন্তা করার কারণে।

 

হ্যনান প্রদেশের চৌ খৌ শহরের থাই খাং জেলার আর লাং মিয়াও প্রাথমিক স্কুলটি হলো স্থানীয় একটি সাধারণ গ্রামের প্রাথমিক স্কুল। চাং ভেং ছেংও সেই স্কুলে লেখাপড়া করতেন। ২০১২ সালে চাং আর লাং মিয়াও প্রাথমিক স্কুলে ফিরে কাজ শুরু করেন। দুই বছর কাজের পর তিনি অন্য গ্রামীণ স্কুলে প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ শুরু করেন।

 

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আবারও আর লাং মিয়াও প্রাথমিক স্কুলে ফিরে যান। তিনি বলেন, আর লাং মিয়াও গ্রামটি হলো তাঁর জন্মস্থান। আবারও সেখানে ফিরে আসতে পেরে তিনি খুব আনন্দিত। তবে তখনকার স্কুলের অবস্থা দেখে তিনি খুব উদ্বিগ্ন হন। তিনি বলেন, তখন স্কুলে মাত্র ৩০টি শিশু ছিল, আর উর্ধ্বতন শিক্ষা বিভাগ এই স্কুলটি বাতিল করতে চেয়েছিল। যদি তাই হয়, তাহলে শিশুদের স্কুলে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে।

 

চাং বাসার সামনের এই প্রাথমিক স্কুলের বিল্ডিং মেরামত করা শুরু করেন। খেলার মাঠ প্রস্তুত করেন, প্রাথমিক স্কুলে ক্যান্টিন ও হোস্টেল নির্মাণ করেন। তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, তা হলো, প্রাথমিক স্কুলে কিন্ডার্গাটেন স্থাপন করা।

চাং বলেন, এভাবে গ্রামের শিশুরা কিন্ডার্গার্টেন থেকে সরাসরি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হতে পারবে। কিন্ডার্গার্টেনের নির্মাণকাজ সুষ্ঠুভাবে এবং সময়মত শেষ করার জন্য, উর্ধ্বতন পর্যায়ের বরাদ্দ ছিল না। তবে চাং নিজের টাকায় ১ লাখ ৪০ হাজার  ইউয়ান দিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে উর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বরাদ্দ আসে, তবে শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের খরচ চালানোও আরেকটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

 

চাং সাংবাদিককে জানান, শিশুদের খাওয়া-দাওয়া, সব কিছুই তিনি ম্যানেজ করেন, স্কুলে অর্থের গুরুতর অভাব। চাং বলেন, কিন্ডার্গার্টেনে প্রতি সেমিস্টারে প্রত্যেক শিশুর জন্য ১ হাজার ইউয়ান ফি লাগে। স্বাভাবিক ক্লাস ছাড়া, শিশুদের ভালো খাওয়া, পরা, ঘুমানো, সবকিছু নিশ্চিত করতে হয়। এভাবে শিশুদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা হয়। যদিও দেশের নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক শিশুর জন্য প্রতিদিন ৪ ইউয়ান দুপুরের খাবারের ভর্তুকি আছে, তবে তা দিয়ে পুরো কিন্ডার্গার্টেন পরিচালনা করা যায় না।

 

চাং শিশুদের ভালো খাওয়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেন। চাং বলেন, শিশুদের প্রতিবার খাবারে মাংস রাখা হয়। দুপুরে মুরগির পা ও ফল থাকে। কিন্ডার্গার্টেনের স্বাভাবিক পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য চাং বিভিন্ন স্থান থেকে ধার নেন। তিনি প্রায় সব আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ধার করেছেন।

একজন শিশুর বাবা মিস্টার চাং সাংবাদিককে বলেন, আগে শিশুরা বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করত। এখন সবাই গ্রামে ফিরে এসে লেখাপড়া করে। প্রিন্সিপাল চাং গ্রামের স্কুলে ফিরে আসার পর সেখানের শিক্ষার মান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে।

 

চাং জানান, বয়স্করা শিশুদের যত্ন নিতে পারেন না। স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে আমি আসলে দাদা ও বাবার মতো শিশুদের সঙ্গে থাকি। প্রতিদিন তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করি। এখন লাং মিয়াও স্কুল একটি বোর্ডিং স্কুল। শিশুদের মধ্যে অধিকাংশ  one-parent family বা সমাজচ্যুত শিশু। পাশাপাশি, যাদের বাবা-মা শহরে চাকরি করে, সেসব শিশু বাধ্য হয়ে দাদা দাদির সঙ্গে জীবন কাটায়।

১৪০টিরও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল দাদা’_fororder_zhang2

আর লাং মিয়াও প্রাথমিক স্কুলের পাঁচটি শ্রেণীতে মোট ৯০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী আছে। তবে শিক্ষক শুধু ৮জন। কিন্ডার্গাটেনে আছে আরও ৫০টি শিশু। এভাবে চাং ১৪০ জনেরও বেশি শিশুর ‘প্রিন্সিপাল দাদা’ হয়ে উঠেছেন। শিক্ষাদানের কাজ ছাড়া তিনি সব শিশুর দৈনন্দিন জীবনের যত্নও নেন।

 

শিশুদের যত্ন নেওয়ার কাজে যে বিষয় চাং-এর কাছে সবচেয়ে স্মরণীয়, তা হলো প্রতিবার গাড়ি চালিয়ে ২০ কিলোমিটার দূরের জেলায় গিয়ে সবজি ও মাংস কেনা। প্রতি সপ্তাহে তিনি ২/১বার সেখানে যান, কারণ দিনের সময় ক্লাস নিতে হয়। তাই প্রতিবার ভোর তিনটায় জেলার পথে রওনা হন। প্রতিবার পুরো গাড়ি ভরা সবজি, ফল ও মাংস কিনে ফিরেন তিনি। আর প্রতিবার সবজি কেনা শেষে স্কুলে ফিরে আসার সময় হলো শিশুদের সবচেয়ে আনন্দের সময়। কারণ সুস্বাদু খাবার আছে। চাং গাড়ি থেকে নেমে দেখেন শিশুরা চাং-এর পায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ফল খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে।

‘প্রিন্সিপাল দাদা, আমি কমলা খেতে চাই’। শিশুদের কণ্ঠ শুনে চাং শিশুদের বলেন: বাচ্চারা, তোমরা নিজে নাও, যেটা ভালো লাগে সেটা নাও।

 

বর্তমানে চাং এই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর প্রধানের কাজও করেন। প্রধানত শিশুদের গণিত ও ইংরেজির ক্লাস নেন। মাঝে মাঝে ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবেও ক্লাস নিতে হয়। তিনি বলেন, সংগীত ও ছবি আঁকা ছাড়া তিনি স্কুলের সব ক্লাস নিতে পারেন। যে ক্লাসে শিক্ষকের অভাব, সেই ক্লাস নেন তিনি।

 

চাং-এর বাসা স্কুলের খুব কাছাকাছি, মাত্র একশ’ মিটার দূরত্ব। স্কুলের মেইন গেটের সামনে তাঁর বাসা দেখা যায়। তবে তিনি এই তিন বছরে খুব কমই বাসায় ফিরে যান, প্রায় সবসময় স্কুলেই থাকেন।

সাপ্তাহিক ছুটিতেও তিনি ব্যক্তিগত কাজ করতে পারেন না। স্কুলের টেবিল মেরামত করা, টয়লেট পরিষ্কার করা- সব কাজই তাঁকে করতে হয়। তিনি বলেন, যদিও কাজগুলো ছোট, তবে অনেক বেশি কাজ।

 

তবে শুক্রবার ও শনিবার রাত হলো তাঁর ফ্রি সময়। কারণ শিশুরা বাসায় ফিরে যায়। চাং নিজের পরিবারের সঙ্গে খাবার খেতে পারেন, আড্ডা দিতে পারেন।

সাংবাদিক জানতে পারেন যে, চাং-এর বাবার বয়স ৭০ বছরেরও বেশি। তিনিও গ্রামীণ শিক্ষক ছিলেন। চাং খুব ব্যস্ত থাকায় চাং-এর বাবাও স্কুলে গিয়ে চাংকে সাহায্য করেন। স্কুল পরিষ্কার করা সহ নানা কাজ করেন। চাং-এর স্ত্রীও স্কুলের একজন শিক্ষক। স্ত্রী চাং-এর সঙ্গে স্কুলেই থাকেন, যাতে শিশুদের যত্ন নেওয়ায় চাং-কে সাহায্য করা যায়। যদিও স্কুলের শিশুদের যত্ন নেন, তারপরও চাং-এর মনে কষ্ট আছে। তিনি বলেন, এখন তাঁর ছোট ছেলে তাঁর স্কুলে লেখাপড়া করছে, তাই ছোট ছেলের যত্ন নিতে পারেন, তবে বড় ছেলে এখন মাধ্যমিক স্কুলে পড়ছে, তিনি বড় ছেলের যত্ন নিতে পারেন না।

তিনি বলেন, শিশুদের সঙ্গে থাকার সময় খুব কম। আমি দেখতে পারি যে, অন্য সন্তানদের বাবা-মা ছেলেমেয়েদের খাবার পৌঁছে দেয়। তবে তিনি এভাবে করতে পারেন না। তাঁর মনে ভীষণ কষ্ট হয়।

 

এই তিন বছরের অর্জন সম্বন্ধে চাং বলেন, যদিও আমার মাথায় সাদা চুল বেড়েছে ও আমি অনেক ঋণী হয়ে পড়েছি, তারপরও শিশুদের হাসিমুখ দেখলে আমার খুব ভালো লাগে। শিশুরা আমাকে দেখলে জড়িয়ে ধরে।

চাং বলেন, তিনি এই কাজ অব্যাহত রাখবেন। এত বেশি শিশু তাঁকে পছন্দ করেন, তিনি নিশ্চয় শিশুদের ভালোভাবে যত্ন নেবেন। একজন শিক্ষক হিসেবে, এই পেশা বাছাই করলে নিশ্চয় তা ভালো করতে হয়। অনেক শিশু প্রতিবছর শুধু একবার বাবা মাকে দেখতে পায়, শিশুরা পরিবারের ভালোবাসা চায়। তাই তিনি এসব শিশুদের সঙ্গে থাকতে চান এবং তাদেরকে বাবা ও দাদার মতো ভালোবাসা দিতে চান। তিনি মনে করেন, এটি খুব সুন্দর ব্যাপার।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)