অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন আমার শিক্ষক
2021-09-30 16:21:40

অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন আমার শিক্ষক

আপনি কখনও কল্পনা করেছেন কি, ছোটবেলায় টিভিতে যাকে অলিম্পিক গেমসের চ্যাম্পিয়ন হতে দেখেছেন, বড় হয়ে তাকেই নিজের শিক্ষক হিসেবে পাবেন? চীনে এমন একটি গল্প আছে। আর অলিম্পিক গেমসের চ্যাম্পিয়নের ক্লাসে যোগ দেওয়া কিন্তু অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর চ্যাম্পিয়নের ক্রীড়া ক্লাসে কিন্তু অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ‘বিশ্বের শীর্ষ’ খেলোয়াড়রা তাহলে কীভাবে ক্রীড়া শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই শুরু করছি আজকের অনুষ্ঠান।

অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন আমার শিক্ষক_fororder_shi

ব্যাডমিন্টনে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন চাং চিয়ে ওয়েন চীনের চুংশান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ক্রীড়া শিক্ষক। তাঁর ক্লাস সকাল দশটা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। ২০১৭ সালে তিনি চুংশান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান শুরু করেন। চার বছরে ক্লাস শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগেই তিনি প্রস্তুত হয়ে যান।

 

সকালের ক্লাস হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের জন্য। দেড় ঘণ্টা ক্লাসের প্রথম এক ঘণ্টা হলো শরীরচর্চা। প্রত্যেক মুভমেন্ট দুই বার করে করতে হয়। কিছু কিছু শিক্ষার্থী এসব মুভমেন্টকে খুব কঠিন মনে করে।

লিউ সি চিয়ে একজন শিক্ষার্থী। তিনি চার বছর ধরে ব্যাডমিন্টন চর্চা করলেও তিনি মনে করেন, শিক্ষক চাং-এর ক্লাস অনেক পরিশ্রমের। তিনি খুব কঠিন, তাঁর মানদণ্ডও অনেক উঁচু। তাই আমাদের অনেক চেষ্টা করতে হয়। তবে, কষ্ট হলেও আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে পারছি।

 

ছাত্রী খুয়াং ই খ্য ব্যাডমিন্টন খেলায় খুব দুর্বল। তিনি একজন নতুন শিক্ষার্থী। চর্চার সময় তাঁর শরীরের ব্যালেন্স করতে পারেন না। তাই শিক্ষক চাং বিশেষভাবে সাহায্য করেন। ছাত্রী খুয়াং বলেন, শিক্ষক চাং খুব কঠোর হলেও খুব স্নেহশীল। আমার একটু অগ্রগতি দেখলে তিনি আমার অনেক প্রশংসা করেন ও উত্সাহ দেন। অলিম্পিক গেমসের চ্যাম্পিয়ন আমাদের খুব কাছের একজন মানুষ।

 

আসলে অলিম্পিক গেমসের চ্যাম্পিয়ন হলেও, ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসের অনেক চাপ আছে। শিক্ষক চাং বলেন, যারা চুংশান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন, তারাই শ্রেষ্ঠ। তাদের চিন্তা ভাবনা এবং প্রশ্ন অনেক বেশি, মাঝে মাঝে ক্লাসের সময় তাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। আর কিছু কিছু প্রশ্ন আসলে আমি আগে কখনওই চিন্তা করি নি। তাই প্রত্যেক ক্লাসের আগে আমি বসে কিছুক্ষণ চিন্তা করি, এই ক্লাস কীভাবে নেবো, কীভাবে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবো ইত্যাদি।

অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন আমার শিক্ষক_fororder_shi2

২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক গেমসে নারীদের দুশ’ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক সাঁতারের চ্যাম্পিয়ন চিয়াও লিউ ইয়াং ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে চুংশান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান শুরু করেন। সাঁতারের ক্লাসকে আরও মজাদার ও আকর্ষণীয় করার জন্য চিয়াও লিউ ইয়াং অনেক চেষ্টা করেছেন। তিনি চেষ্টা করেন যে, ক্লাসে যত কম কথা বলা যায়, যাতে শিক্ষার্থীরা হালকা মেজাজে সাঁতারের কলাকৌশল শিখতে পারে।

 

চুংশান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইয়াং ইয়া আন বলেন, তিনি  কখনও ভাবেননি যে, ছোটবেলায় যে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নকে টিভিতে দেখেছিলেন, একদিন তিনিই তার শিক্ষক হবেন।

কাছ থেকে নিজের আদর্শ ব্যক্তিকে দেখতে পারা অনেক বড় ব্যাপার। তা ছাড়া, শিক্ষার্থীরা এসব অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের কাছ থেকে অলিম্পিকের চেতনাও শিখতে পেরেছে।

অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন আমার শিক্ষক_fororder_shi3

২০০৪ সালে এথেন্স অলিম্পিক গেমসের তায়েকোয়ান্দো ইভেন্টের নারীর ৬৭ কেজি পর্যায়ের স্বর্ণপদক অর্জনকারী লুও ওয়েই চুংশান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ বছর শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর ক্লাসে উশু তায়েকোয়ান্দো কৌশল শেখার পাশাপাশি প্রত্যেক বার ‘salute’ এর মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনও শেখান তিনি; অন্যকে যত্ন নেওয়ার বিষয়টিও শেখান তিনি।

 

লুও ওয়েই বলেন, তাঁর ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে পছন্দের অংশ হল ‘গল্পের সময়’। লুও ওয়েই বলেন, আমি আমার স্বর্ণপদক অর্জনের মুহূর্তের কথা বলার পাশাপাশি, তাদেরকে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হওয়ার কথা, আহত হওয়ার কথা জানাই। তাদেরকে জানাই, আমি কীভাবে খারাপ অবস্থা থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি কীভাবে বিরাট কঠিন অবস্থা মোকাবিলা করেছিলাম। যখন আমি হাল ছেড়ে দিতে চাইতাম, তখন আমি কীভাবে আবারও মনের জোড়ে ঘুরে দাঁড়াতাম- ইত্যাদি।

 

শিক্ষকের জীবনে যে বিষয়টি মনে সবচেয়ে গভীর ছাপ ফেলে, সে বিষয়ে চিয়াও লিউ ইয়াং বলেন, একজন ছেলে, সাঁতারের প্রথম ক্লাসে পানিতে নামতে ভয় পায়। সে পুলের পাশে দাড়িয়ে বলে, ছোটবেলায় সে পানিতে ডুবে গিয়েছিল, তাই তার ভয় লাগে, সে মনে করে, সে কখনই সাঁতার কাটা শিখতে পারবে না। সে আমাকে বলে, সে শুধু আমাকে দেখার জন্য এসেছে। তখন চিয়াও লিউ ইয়াং এই ছেলেকে বলেন যে, সমস্যা নেই, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো, তুমি আমাকেও বিশ্বাস করতে পারো। আমি এখানে আছি, আমি তোমার নিরাপত্তা দেবো। আমি তোমাকে উদ্ধার করবো।

 

৯ ক্লাস প্রশিক্ষণের পর, পরে এই ছেলে সাঁতার কাটতে সক্ষম হয়। চিয়াও লিউ ইয়াং মনে করেন, এটি খুব বড় একটি সাফল্য। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলও, এই ছেলের কাছে, ভবিষ্যতে যে কোনো কঠিনতার মুখোমুখি হলে, সাঁতার শেখার কথা স্মরণ করে সে আবারও সাহস যোগাড় করতে পারবে।

 

লুও ওয়েই মনে করেন, চীনারা এখনও ক্রীড়া খাতে বেশি গুরুত্ব দেয় নি। আসলে ক্রীড়া যুবকদের মনে সক্রিয় প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, একজন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় ও ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে, আমার উচিত ছাত্রছাত্রীদের জানানো যে- ক্রীড়া কত গুরুত্বপূর্ণ। তারা খেলা থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারে। শুধু নিজের জন্যই না, তারা ভবিষ্যতে হয়তো কোনো শিশুর প্রথম ক্রীড়া শিক্ষক হতেও পারবে। তারা শিশুদের নিয়ে প্রত্যেক খেলায় অংশ নেবে। তারা ক্রীড়া থেকে সারা জীবন লাভবান হবে। এটাই হলো একজন শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব।

 

ছাত্রছাত্রীদের মনের ‘ধ্রুবতারা’- শিক্ষক মা চিয়ান কুও

সানতুং প্রদেশের হ্যচ্য শহর থেকে হেই লুং চিয়াং প্রদেশের মোহ্য শহর পর্যন্ত ২৭০০ কিলোমিটার দূরত্ব। ২৪ বছর বয়সে শিক্ষকতা শুরু করার পর মা চিয়ান কুও ২৪ বছর ধরে শিক্ষাদান করেছেন। তাঁর স্কুল বেইজি থানার কেন্দ্রীয় স্কুল। এটি চীনের হেই লুং চিয়াং প্রদেশের মোহ্য শহরের বেইজি গ্রামে অবস্থিত। যা চীনের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত। তাই স্কুলটিকে বলা হয় ‘সবচেয়ে উত্তরের স্কুল’।

মা চিয়ান কুও’র জন্মস্থান সানতুং প্রদেশে। ১৯৯৭ সালে তিনি হেইলুংচিয়াং প্রদেশের ক্যশান নর্মাল বিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করে সেখানে বসবাস করতে থাকেন।

প্রথম বেইজি গ্রামে পৌঁছার সময় মা স্কুলের অবস্থা দেখে খুশি হতে পারেন নি।

 

জেলা থেকে গ্রামে যাওয়ার কোনো সড়ক ছিল না। ৮০ কিলোমিটার পথ যেতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। গ্রামে বিদ্যুত সংযোগ নেই, তাই ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা হয়। রাতের বেলা বিদ্যুত্ থাকে না, সবখানে অন্ধকার। আর বেইজি গ্রামে শীতকালও খুব আগে আসে। সেপ্টেম্বর মাসেই তুষার পড়া শুরু হয়। ছয় সাত মাস স্থায়ী হয় ভয়াবহ শীতের দিন। তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ৪০ বা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। স্কুলে শুধু কাঠ জ্বালিয়ে উষ্ণতার ব্যবস্থা করা হয়।

আরেকটি বিষয় নিয়ে মা বেশ উদ্বিগ্ন, তা হলো ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার খারাপ অবস্থা।

 

ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া আরও ভালো করার জন্য শিক্ষক মা ক্লাসে শিক্ষাদানের পাশাপাশি ক্লাসের বাইরেও অনেক চেষ্টা করেন, ছাত্রছাত্রীদের শেখান। চীনা ভাষা, গণিতবিদ্যাসহ  স্কুলে যে বিষয়ের শিক্ষকের অভাব, মা সেসব বিষয় শেখান। তিনি বলেন, শিক্ষকের অভাব থাকায় একজন শিক্ষককে নানা বিষয় শেখাতে হয়, এটি স্কুলে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রামে, কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকা অভিভাবকরা শিশুদের যত্ন নিতে পারেন না। তাই বাবা-মা রাতেও শিশুদের স্কুলে রাখে।

 

২০০৭ সালে এক শীতের রাতে, রাতের পাঠদান শেষ করে মা বাসায় ফিরছিলেন। হঠাত্ বরফে হোঁচট খেয়ে পিছলে পড়ে যান। এতে তাঁর ডান পা’র হাড় ভেঙে যায়। চিকিত্সক তাকে কয়েক সপ্তাহ বিছানায় থাকার কথা বলেন, তবে শিক্ষক মা বাসায় শুধু এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেন। তারপর হুইলচেয়ারে বসে এবং স্ত্রীর সাহায্যে আবারও ক্লাসরুমে ফিরে যান। কারণ ক্লাসে ৩০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে। তিনি তাদের নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন।

 

শিক্ষক মা বলেন, আমি যখন ক্লাসরুমে ফিরে যাই, শিশুরা আমাকে স্বাগত জানায়। তারা আমাকে এমন কষ্ট করে ক্লাস নিতে দেখে খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেন। শিক্ষক মা বলেন, সেই বছর ক্লাসে ৬টি শিশু প্রধান উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিল। যা ছিলো ওই গ্রামটির সর্বোচ্চ ফলাফল। সেই বছর তাঁকে ‘দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের’ মর্যাদা দেওয়া হয়।

শিক্ষক মা’র মনে, শিক্ষক শুধু ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানই শেখান না, তারা ছাত্রছাত্রীদের ভালো আচরণ ও ভালো গুণাবলীও শেখান।

 

মা’র একটি ছাত্রের নাম ছুং হুং ইয়াং। ছোটবেলা থেকেই তার পায়ে সমস্যা ছিল। বাবা মা তাঁকে পিঠে করে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। ছুং-এর শারীরিক অবস্থা খুব দুর্বল, তাঁর বাবা মা একসময় তাঁকে স্কুল থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। শিক্ষক মা এই অবস্থা জেনে ক্লাসে একটি ‘স্বেচ্ছাসেবক’ দল গঠন করে ছাত্র ছুংকে সাহায্য করা শুরু করেন। তখন থেকে তুষার হোক বা বৃষ্টি হোক, ছুং-কে একটি ক্লাসও মিস করতে হয়নি।

 

শিক্ষক মা বলেন, শিশুদের পরিবর্তন দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। একজন শিক্ষকের জন্য এটি হলো প্রকৃত আনন্দ।

স্কুলটি অনেক দূরে এবং পরিস্থিতি খুব কঠিন হওয়ায় যেসব শিক্ষক স্কুলে আসতেন, তাঁরা অনেকেই চলে গেছেন। ২০০২ সাল থেকে স্কুলের প্রধান এবং শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা বার বার শিক্ষক মাকে আরও ভালো স্কুলে নিয়োগের প্রস্তাব দেন। তবে মা এতে রাজি হননি। কারণ তিনি মনে করেন, এখানকার শিশুদের তাঁকে বেশি প্রয়োজন।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা-এর স্কুলের অবস্থাও অনেক উন্নত হয়েছে। বিভিন্ন আধুনিক জিনিস লাগানো হয়েছে। শুধু নিজের গ্রামেই নয়, বরং বাইরের অনেক ছাত্রছাত্রীও এখন এই স্কুলে ভর্তি হতে চায়।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)