আজহার লিমন, ঢাকা: গেল বছরের অক্টোবরে ‘বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ সুকুক গাইডলাইন ২০২০’ নামে শরিয়াহভিত্তিক বন্ড নীতিমালা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ১ মাস পর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’-এর টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যে সুকুক বন্ড ছাড়ে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা তোলার লক্ষ্যে দুই দফা নিলামের প্রথম ভাগে ৪ হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড ছাড়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রথম দফায় ৪ হাজার কোটি টাকার বন্ডের বিপরীতে সুকুক সনদের আবেদন পড়েছিলো ৩৯টি, আবেদকারীদের চাহিদার অংক প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় এই ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলামের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, নতুন করে শরিয়াহভিত্তিক এই অর্থ ব্যবস্থা কেন এবং এর প্রতি এত আগ্রহেরই বা কারণ কী?
জনাব সিরাজুল বলেন, “মানুষের ভেতরের ইসলামিক চিন্তা চেতনার কারণেই এই জিনিসটা বেশি এক্সপ্লোয়েট করছে। ইসলামিক ব্যাংকের এই জাতীয় ইনস্ট্রুমেন্ট না থাকার কারণে তাদের প্রতিও একটা ই করা হচ্ছিলো যে তারা সব জায়গায় পার্টিসিপেট করতে পারে না। তারা এই জায়গায় পার্টিসিপেট করলে বা ক্রয় করলে এই জিনিস টা তারা তাদের একটা সিকিউরিটি হিসেবে রাখতে পারবে। সুতরাং এটা তাদের জন্য একটা বিশাল ব্যাপার ছিলো।”
সিরাজুল ইসলাম
অবশ্য সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইসলামী শরীয়াহ অনুসরণ করে পরিচালনার বেশ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুদভিত্তিক প্রচলিত অনেক বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী শরিয়াহ অনুসারে পরিচালিত হওয়ার জন্য নিজেদের কাঠামোতেও পরিবর্তন এনেছে।
সব মিলিয়ে দেশে ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি কিন্তু সামগ্রিক গ্রাহকদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এসব ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক ড. মো. বখতিয়ার হাসানের কাছে প্রশ্ন ছিলো, মানুষের এই আগ্রহের জন্যই কি বন্ডের ইসলামীকীকরণ?
ড. বখতিয়ার বলেন, “যেহেতু এটা শরীয়াহভিত্তিক। কাজেই যারা মুসলিম বিনিয়োগকারী তাদের জন্য এখানে দুইটা লাভ। একটা হচ্ছে পার্থিব যে সুখ বা রীতি সেটা কিন্তু এখানে নিশ্চিত করা যাচ্ছে। যে আমি সুদভিত্তিক বিনিয়োগ করছি না, একটা সম্পদের ওপর বিনিয়োগ করছি। আরেকটা হচ্ছে যে আর্থিক। আর্থিক সুবিধাটা হলো নরবাল বন্ডগুলোতে কোন মালিকানা দেওয়া হয় না এবং ঐ বন্ডগুলোর বিপরীতে কোন সুনির্দিষ্ট সম্পদও সংরক্ষণ করে রাখা হয় না। কিন্তু শরীয়াহ ভিত্তিক এই বন্ড সুকুক যেটা এখানে কিন্তু সুনির্দিষ্ট সম্পদ থাকতে হবে। যে সম্পদের বিপরীতেই সুকুক সনদ দেওয়া হবে।”
ড. মো. বখতিয়ার
বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে এই বিশ্লেষক বলছেন, সংকটকালীন সময়েও বিকল্প এই অর্থ ব্যবস্থা ভালো করেছে ও স্থিতিশীলতা দেখিয়েছে। এবং বাস্তবতাও হলো মুসলিম দেশগুলোর মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মত অমুসলিম দেশগুলোতেও দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে বিনিয়োগের এ শরীয়াহ পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামী এই বন্ড ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চ্যালেঞ্জ কতটা?
তিনি বলেন, “সবথেকে বড় যে চ্যালেঞ্জ সেটা হলো, সুকুক হলো একটি শরীয়াহভিত্তিক অর্থ উপকরণ, তাই এর জন্য একটি পার্টিকুলার একটি ল এন্ড রেগুলেশন থাকা উচিত। তা না হলে প্রচলিত বন্ডের মত মিক্স আপ হতে পারে। এর ফলে সুকুকের আসল যে উদ্দেশ্য যেটা হলো শরীয়াহ ভিত্তিক বিনিয়োগ সেটা হয়তো হারিয়ে ফেলবে। এই এই ম্যাসেজ যদি কোনভাবে ধর্মভীরু বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছায় তাহলে নেগেটিভ ম্যাসেজ হয়তো তাদের দিতে পারে।”
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা থমসনের ২০১৬-১৭ সময়ে প্রকাশ করা বৈশ্বিক ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বৈশ্বিক ইসলামী অর্থায়নে সম্পদের পরিমাণ ছিল দুই ট্রিলিয়ন বা দুই লাখ মার্কিন ডলার। বলা হয়, ইসলামী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এতই ইতিবাচক যে, চলতি বছরেই সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।