পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষিবিদ্যা হল পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষিবিজ্ঞানের সমন্বয়ে গঠিত একটি নতুন ক্রস-ডিসিপ্লিন। এটি কৃষি উত্পাদন কার্যক্রমের প্রক্রিয়া প্রকাশ বা ব্যাখ্যা করার জন্য একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রদান করে এবং এটি কৃষি আধুনিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। সাধারণভাবে, এর মধ্যে রয়েছে বিকিরণ প্রজনন, কৃষি আইসোটোপ ট্রেসিং এবং পারমাণবিক বিশ্লেষণ কৌশল, খাদ্য বিকিরণ সঞ্চয় এবং সংরক্ষণ এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষিবিজ্ঞানের একজন বিশেষজ্ঞের গল্প তুলে ধরবো, যিনি চীনের পারমাণবিক কৃষিবিজ্ঞানে বিভিন্ন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। তিনি চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম আইসোটোপ পরীক্ষাগার স্থাপন করেছেন, চীনের প্রথম কীটনাশক ব্যবহারের নিরাপত্তার মানদন্ড তৈরি করেছেন, এবং আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরামর্শ কমিটির প্রথম চীনা বিজ্ঞানী।
চলতি বছর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে যারা সিপিসি’র সদস্য হিসেবে ৫০ বছর ধরে অবদান রেখে আসছেন, তাদেরকে ‘সিপিসির ৫০ বছরের সদস্য’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাদের একজন অধ্যাপক ছেন জি ইউয়ান, যিনি চীনের সুবিখ্যাত পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষির একজন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ। তাঁর বয়স ৯৭ বছর। সারা জীবনের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কৃষিকাজকে সারা জীবনের দায়িত্ব হিসেবে বেছে নেওয়া আমার জন্য গর্বের ব্যাপার। আমার সব অর্জন ও সাফল্য দেশ ও জনগণের সাহায্যে অর্জিত হয়েছে।’
১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে চীনের শাংহাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন জনাব ছেন জি ইউয়ান। ১৯৪৪ সালে তিনি শাংহাই তাসিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতক হন এবং পরে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি চেচিয়াং প্রদেশের কৃষি একাডেমিতে যোগ দেন এবং সেখানকার সহকারী অধ্যাপক ও রাসায়ন বিভাগের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সিপিসি-তে যোগদান করেন তখন তিনি কৃষি একাডেমির একমাত্র অধ্যাপক। তখন থেকে তিনি চীনের একজন সেরা বিজ্ঞানী হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেন।
১৯৫৬ সালে চীনের প্রথম বিজ্ঞান উন্নয়নের পরিকল্পনা রচনা করা হয়। তখন পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ প্রয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। সেই সময় চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তি অনুসারে শাংহাইয়ে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ ক্লাস চলতো। তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পরমাণু বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা শেখার জন্য চীনের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সেরা শিক্ষার্থীদের বেছে নেওয়া হতো। তখন জনাব ছেন জি ইউয়ান নির্বাচিত হন। চেচিয়াং প্রদেশের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ জনেরও বেশি, যারা ৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শাংহাই যান এবং কৃষিতে আইসোটোপ প্রয়োগ দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রশিক্ষণ গ্রহণের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট গবেষণাকাজও শুরু হয়। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে চীনের চেচিয়াং প্রদেশের কৃষি একাডেমিতে আইসোটোপ পরীক্ষাগার স্থাপন করেন ছেন জি ইউয়ান এবং তখন থেকে তিনি রাসায়ন বিষয়ের পরিবর্তে পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন।
১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে আইসোটোপ পরীক্ষাগার নির্মাণের পর বিভিন্ন সরঞ্জাম ও প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনার অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট গবেষণার কাজ শুরু হয়। তেজস্ক্রিয় উত্স বেইজিং থেকে পরিবহন করা হয়, অধ্যাপক ছেন নিজে পরীক্ষায় অংশ নেন। এর সঙ্গে সঙ্গে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কৃষিতে আইসোটোপের প্রয়োগ’ বিষয়ক প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু করেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষি নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং বায়োফিজিক্স বিভাগও প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে চেচিয়াং কৃষি একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে চেচিয়াং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নাম গ্রহণ করে এবং সর্বপ্রথমে পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষিবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে।
তবে ১৯৬০ সালের পর চীনে টানা কয়েক বছর ধরে নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে এবং চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার কারণে পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষিবিজ্ঞানের গবেষণাকাজ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাস্তবতা বিবেচনা করে অধ্যাপক ছেন গ্রামাঞ্চলে গিয়ে কৃষিউত্পাদনের জন্য তাত্পর্যপূর্ণ গবেষণা চালাতে থাকেন।
বিশাল কৃষিক্ষেতে তিনি কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে চাইলে রেডিওআইসোটোপ লাগিয়ে কীটনাশক চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তখন চীনে এ জিনিস তৈরি হতো না। সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এ জিনিস অনেক দামীও বটে এবং আমদানির জন্য সময়ও বেশি লাগে। তাই গবেষণার গতি দ্রুত করার জন্য তিনি কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে নানান ধরনের রেডিওনুক্লাইড দিয়ে জৈব ফসফরাসসহ ১৫টি উপাদান দিয়ে কীটনাশক চিহ্নিত করেন, যা চীনের সংশ্লিষ্ট গবেষণাকাজের শূন্যস্থান পুরণ করেছে।
এ প্রযুক্তির মাধ্যমে অধ্যাপক ছেন জি ইউয়ান ও গবেষকরা কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ নিয়ে গবেষণায় অনেক সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি চীনের কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ চিহ্নিতবিষয়ক থিসিস রচনা করেন। তিনি চীনের প্রথম বিশেষজ্ঞ যিনি আইসোটোপ প্রয়োগ করে কীটনাশকের অবিশিষ্টাংশ চিহ্নিত করার কৌলশ আবিষ্কার করেন।
প্রায় একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের একজন পণ্ডিত রাচেল কারসন ‘নিবিড় বসন্তকাল’ শীর্ষক বই রচনা করেন, যাতে পরিবেশ দূষণ নিয়ে আলোচনা আছে। তবে সেই সময় মার্কিন পণ্ডিত যেই সমস্যার কথা উল্লেখ করেন, চীনা বিশেষজ্ঞ ছেন জি ইউয়ান ততোদিনে তা সমাধানের জন্য চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন।
গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকে শিল্প ও কৃষির দূষণ ব্যাপারটি সারাবিশ্বের পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। কীটনাশক দূষণের কারণে ডিম ও মুরগীসহ বিভিন্ন পণ্য কীটনাশক অবশিষ্টাংশের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছিল না, যা ছিল চীনের রপ্তানিবাণিজ্যের জন্য একটা বড় ক্ষতি। এমন পরিস্থিতিতে চীনের কৃষি ও বন মন্ত্রণালয় নতুন ও নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহারের মানদন্ড তৈরি করে। তখন চেচিয়াং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
চীনের কীটনাশক অবশিষ্টাংশ ও নিরাপদ ব্যবহার মানদন্ডের গবেষণা প্রকল্প ১৯৭৪ সালে শুরু হয়। জনাব ছেন জি ইউয়ান এ প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি চীনের ২২টি প্রদেশের ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২০০ জন গবেষককে নিয়ে বিশেষ গবেষণাদল গঠন করেন। টানা ৬ বছরের প্রচেষ্টায় অবশেষে ২৯টি প্রজাতির কীটনাশক ও ১৯টি কৃষি-ফসলের সাথে জড়িত ‘কীটনাশকের নিরাপদ ব্যবহার মানদন্ড’ তৈরি করা হয়। ১৯৮৪ সালে এ মানদন্ড চীনের পরিবেশ সংরক্ষণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়, যা এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে।
১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় অধ্যাপক ছেন তাঁর গবেষকদল নিয়ে আলবেনিয়ায় ছয় মাস কাজ করেন। ১৯৮০ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে তিনি চীনের কৃষি পরিবেশ সংরক্ষণ পর্যবেক্ষকদলের উপ-প্রধান হিসেবে জার্মানি সফর করেন এবং ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবার মার্কিন ওরেগন অঙ্গরাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরব্যাপী গবেষণাকাজে অংশ নেন।
১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বে ‘কৃষির ওপর কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক গবেষণাকাজ হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার বিজ্ঞান পরামর্শ কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন তিনি। এ কমিটি বিশ্বের ১৬টি দেশের ১৬ জন বিজ্ঞানী ও উপদেষ্টা নিয়ে গঠিত। তিনি এ কমিটির একমাত্র চীনা বিজ্ঞানী।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থায় নিযুক্ত চীনা কাউন্সিলার ফি জি শি ছেনের প্রশংসা করে বলেন, অধ্যাপক ছেন তাঁর কার্যমেয়াদে চমত্কারভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং চীনের জন্য গৌরব বয়ে এনেছেন।
১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে অধ্যাপক ছেন চেচিয়াং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর প্রশাসনে চেচিয়াং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চীনের শীর্ষ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষিবিজ্ঞান একটি নতুন ধরনের বিজ্ঞান হিসেবে পরমাণু শিল্পের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান পায় এবং তা কৃষির আধুনিকায়নের প্রতীক। অধ্যাপক ছেনসহ বিভিন্ন গবেষকের প্রচেষ্টায় চীনে এ বিজ্ঞান দ্রুত উন্নত হয়েছে।
২০১৮ সালের শেষ দিকে চেচিয়াং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৬০তম বার্ষিকীতে জনাব ছেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চীনের কৃষির উন্নয়নে নিজেদের অবদান রাখবেন বলে আশা করা যায়। যদিও তাঁর অনেক বয়স হয়েছে, তিনি চীনের সেরা কৃষিবিজ্ঞানী ও দক্ষ ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণে নিজের অবদান রেখে যাবেন।
সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)