চীনের সেরা শিক্ষক কুও ওয়েন আনের গল্প
2021-09-26 14:31:48

চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১১০তম বার্ষিকীতে ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তখন তিনি বলেছিলেন, শিক্ষকরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। উচ্চমানের শিক্ষকের অভাব হলে শিক্ষার্থীরা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।  শিক্ষকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশাগুলোর অন্যতম। কারণ, তাদের মর্যাদা ও মানের সঙ্গে দেশের নাগরিকদের গুণগত মানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীদের জন্য  দৃষ্টান্ত হতে হবে।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনীতি ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এর শিক্ষাব্যবস্থা ও সেরা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা উল্লেখযোগ্য। তাই বলা যায়, শিক্ষা একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের সাথে সম্পর্কিত। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের একজন সেরা শিক্ষকের গল্প তুলে ধরবো, যিনি টানা ৬৯ বছর ধরে শিক্ষকতার কাজ করে আসছেন; তাঁর নাম কুও ওয়েন আন।

চীনের সেরা শিক্ষক কুও ওয়েন আনের গল্প_fororder_gwa

১৯৫২ সালে জনাব কুও ওয়েন আন হুয়াচুং উচ্চ পর্যায়ের নর্মোল স্কুল তথা বর্তমানের হুয়াচুং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং এর পর থেকে টানা ৬৯ বছর ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ করে আসছেন। গত ৬৯ বছর তিনি মনোযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, গবেষণার কাজও বন্ধ করেননি। তার বহু বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার ফসল তার ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ নামক বই।

একটি সেরা পাঠ্যপুস্তক ব্যাপক গবেষণার ফল। অধ্যাপক চাং তাও জুনের ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বইটি প্রকাশিত হবার পর গত ৪০ বছরে এ বই বিক্রি হয়েছে ৮০ লক্ষাধিক কপি। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকগুলোর মধ্যে এ বইটির প্রভাব সবচেয়ে বেশি বলে ধারণা করা হয়।

গত শতাব্দীর ৬০-এর দশক থেকে জনাব কুও ওয়েন আন এ বইটির রচনাকাজ শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন থেকে শিক্ষাবিদ্যা ও শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। কারণ, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় একটি নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষাবিজ্ঞান একটি মৌলিক ক্লাস হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের উদ্যোগে ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ পাঠ্যপুস্তকের রচনাকাজ শুরু হয় এবং বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করে অবশেষে প্রথম বইটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়। তখন শিক্ষক কুও মাত্র বইটির দুইটি অধ্যায় রচনা করেতে পেরেছিলেন।

এ সম্পর্কে অধ্যাপক কুও বলেন, “আমার জানার মধ্যে তখন চীনের পাঁচটি নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয় ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে অবশেষে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বই ছাপাতে পেরেছে। যদিও বর্তমানের দৃষ্টিতে আমাদের প্রথম পাঠ্যপুস্তকের কোনো-না-কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, তবে তা আমাদের ভবিষ্যতের নতুন পাঠ্যপুস্তকের রচনায় একটি ভালো ভিত্তি স্থাপন করেছে।”

১৯৭৮ সালে চীনের আরো কয়েকটি নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে নতুন করে ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বইটি রচনা করেন অধ্যাপক কুও। তিনি নৈতিকার অধ্যায় লিখে ফেলেন এবং এ বই সংশোধনের জন্য বেইজিংয়ে যান। ১৯৮০ সালে পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যৌথরচিত ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বই অবশেষে প্রকাশিত হয় এবং ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। তারপর থেকে এই বই বারবার ছাপা হয়েছে। তখন থেকে চীনের শিক্ষাবিজ্ঞানও দ্রুত উন্নত হতে থাকে। বিদেশের শিক্ষাবিষয়ক বইগুলো চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং পাশ্চাত্য দেশগুলোর উন্নত শিক্ষা-অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা-গবেষণার সাফল্যও তুলে ধরা হয়।

এ সম্পর্কে অধ্যাপক কুও স্মরণ করে বলেন যে, ১৯৮২ সালের শেষ দিকে তাঁর স্কুলে আবার নতুন ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বই রচনার কাজ শুরু হয়। তবে এবারের রচনা কেবল সংশোধনের কাজ নয়, বরং আধুনিক শিক্ষার পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা ছিল।

বহু বছর আগের কথা। কিন্তু তিনি স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারেন। এ সম্পর্কে কুও বলেন, “আমি নৈতিকতার প্রশিক্ষণ নিয়ে দুটি অধ্যায় লিখেছি এবং পরে ‘ক্লাসের প্রধান শিক্ষক’ অধ্যায়টি লিখেছি। মোট এক বছরেরও বেশি সময় দিয়ে তিনটি অধ্যায় সম্পন্ন করেছি। পরে ‘শিক্ষাদান’ বিষয়ক তিনটি অধ্যায় লেখার কাজও আমার হাতে পৌঁছায়। সংস্করণ রচনার কাজ অনেক বেশি ও কঠিন ব্যাপার ছিল। তাই আমি অনেক বই পড়েছি এবং পাশ্চাত্য দেশগুলোর শিক্ষাবিজ্ঞানের বই পড়েছি। পড়ার পর আমার অনুভূতি বইয়ে শেয়ার করেছি, নতুন তত্ত্ব দিয়েছি। নতুন সংস্করণের বইটিতে শিক্ষাদানের উদাহারণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তত্ত্ব ও অনুশীলনের সংমিশ্রণের কারণে পাঠকদের জন্য বইটি আরও উপযোগী ও আকষর্ণীয় হয়েছে, যা এ বইয়ের বৈশিষ্ট্য।”

তত্ত্বের পাশাপাশি উপযুক্ত উদাহরণও দিতে হবে, সাথে সাথে নিয়মিত শিক্ষাদানের কাজও থাকে; ফলে তাঁর লেখার গতি একটু ধীর ছিল। দুই বছর পরও লেখার কাজ  সম্পন্ন হয়নি। তখন বইয়ের প্রধান সম্পাদক ওয়াং তাও জুন নিজে কুও’র বাড়িতে যান। তিনি লেখাগুলো পড়ার পর বলেন, ‘আপনি মনোযোগ দিয়ে লেখেন, হুড়াহুড়ি করতে হবে না।’ ফলে, ৭ বছর পর এ বই প্রকাশিত হয়। তখন প্রকাশনালয়ের সম্পাদক কুও’র লেখা পেয়ে বলেন যে, বই কোনো ভুল নেই বললেই চলে, বইয়ের মানও অনেক ভালো। ১৯৮৯ সালে নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ বইটি টানা ৭ বারের মতো সংশোধিত হয়েছে। অধ্যাপক কুও শিক্ষাদানের কাজ করার সাথে সাথে মনোযোগ দিয়ে বই সংশোধনের কাজ করে গেছেন।  নতুন মেজরের বিষয় ও শিক্ষা উন্নয়নের পরিবর্তন তুলে ধরতে প্রচেষ্টা চালান তিনি।

ব্যক্তিগত বই রচনার তুলনায় পাঠ্যপুস্তকের বই লেখাকে অনেকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না। কেউ কেউ সমালোচনা করে বলেন যে, এতো বেশি সময় দিয়ে পাঠ্যপুস্তক লেখার দরকার নেই; এ সময় বিজ্ঞান-গবেষণা করা আরও ভালো। এ সম্পর্কে অধ্যাপক কুও বলেন, পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে মূল বিষয়ের বৈশিষ্ট্য, শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও মানসহ অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে সর্বশেষ বিজ্ঞান গবেষণার সাফল্য, বিষয়ের উন্নয়নের সম্ভাবনাসহ অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। তাই পাঠ্যপুস্তক রচনা সহজ ব্যাপার নয়, বরং এটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জের বিষয়।

যদিও একে ‘কঠিন’ কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি, তবে দীর্ঘকাল ধরে এ কাজই করে এসেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে একটি সেরা পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, শিক্ষাবিজ্ঞানের দুটি ভুমিকা রয়েছে। একদিকে শিক্ষক হওয়ার ভিত্তি স্থাপন করা এবং আরেকটি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরি করা। শিক্ষাবিজ্ঞানে অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে  মৌলিক ধারণা ও তত্ত্ব যুক্ত করা হয়েছে; লেখাপড়ার ভিত্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পরের গবেষণাকাজও এতে যোগ করার সুযোগ থাকবে।

কেবল ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বইটি রচনায় মনোযোগ দিয়েছেন তিনি এমন নয়, বরং শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে দায়িত্ব পালন করে গেছেন অধ্যাপক কুও। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের জন্য আমার অনেক আবেগ রয়েছে। মাঝে মাঝে তারা লিখিত প্রবন্ধ নিয়ে আমার কাছে পরামর্শ চায়, তখন আমি অবশ্যই সাহায্য করি। আমার পরামর্শ ও প্রস্তাব দেই, তাদের প্রবন্ধের সংশোধনে সহায়তা দেই। আমার চরিত্র নরম, তাই শিক্ষার্থীরা আমাকে পছন্দ করে।” কেন এতো ব্যস্ততার মধ্যে এতো বেশি কাজ করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি হাসিমুখে বলেন, যদি এ কাজকে  আপনি নিজের দায়িত্ব হিসেবে নেন, আর ক্লান্তির ভয় থাকে না। তা ছাড়া, শিক্ষার্থীদের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষক নিজেও অনেক কিছু শিখতে পারেন।

২০২১ সাল চীনের রেনমিন প্রকাশনালয় প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। তখন অধ্যাপক কুও ওয়েন আনসহ ৭০ জন লেখককে সেরা লেখকের পুরস্কার দেওয়া হয়। চীনের শিক্ষাদান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক রচনায় চমত্কার অবদানের জন্য তিনিও পুরস্কার পান। চলতি বছরে তিনি ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ বইয়ের অষ্টম সংস্করণের কাজ শুরু করেছেন। যদিও তাঁর বয়স ৯০ বছরেরও বেশি, তবে তিনি বলেন, শরীর ঠিক থাকলে এ কাজের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রসঙ্গ

২০২১ সালের নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে। এ বছর ঝড়বৃষ্টি, বন্যা বা কোভিড-‌১৯ মহামারীর কারণে বিভিন্ন শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল। তাদের সহায়তা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে ও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর বিস্তারিত তদন্ত সাপেক্ষে সহায়তা পাবে। যাদের পরিবার ঝড়বৃষ্টি, বন্যা বা মহামারীর কারণে দরিদ্রতর হয়েছে, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা দেওয়া হবে। পাশাপাশি, এসব শিক্ষার্থীর নামও গোপন রাখা হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগ নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তির কাজে সহজতর সবুজ চ্যানেল স্থাপন করবে। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাদের নির্দিষ্ট ভর্তুকি ও সহায়তা দিতে হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগ রাষ্ট্রীয় পড়াশোনা ঋণসংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে সংশ্লিষ্ট সহায়তানীতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাবে। ঋণের পরিমাণ এমন হতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটে। আবর পড়াশোনাশেষে সেই ঋণ ফেরত দিতেও শিক্ষার্থীদের উত্সাহিত করা হবে। ঋণের জন্য আবেদনের সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াও সহজতর করতে হবে।  

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)