নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৪ সেপ্টেম্বর এ ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। নানা কারণে প্রধানমন্ত্রীর এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং জাতিসংঘে ভাষণ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
করোনার দীর্ঘ ১৭ মাসের মধ্যে এটি প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বিদেশ সফর। আর এবার নিয়ে ১৭বার জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিলেন শেখ হাসিনা। গত বছর ভার্চুয়াল ভাষণ মিলিয়ে জাতিসংঘে তিনি ভাষণ দিয়েছেন ১৮ বার। জাতিসংঘে সবচেয়ে বেশি ভাষণ দেয়ার রেকর্ডটি এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দখলে। এর আগে রেকর্ডটি ছিল মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের। তিনি ১৬বার ভাষণ দেন জাতিসংঘে।
আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যুক্ত হয়েছে শেখ হাসিনার এবারের ভাষণের সঙ্গে। ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের দিন। ১৯৭৪ সালের এদিনে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং বাংলায় ভাষণ দেন। ওইদিন বিশ্ববাসী আনুষ্ঠানিকভাবে জেনেছিল বাংলা ভাষা ও সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা। এই সেপ্টেম্বরেই জাতিসংঘ স্বাধীন বাংলাদেশক স্বীকৃতি দিয়েছিল।
পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বরাবরই বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন বিশ্বসংস্থায়। এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের স্মরণে জাতিসংঘ সদরদপ্তরের উত্তর লনের বাগানে একটি বেঞ্চ উৎসর্গ করেন বঙ্গবন্ধুর নামে। সেখানে একটি গাছও লাগান শেখ হাসিনা। এ সব কারণে এবার প্রধানমন্ত্রীল জাতিসংঘ সফর বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়েছে এবং একে ঐতিহাসিক বলেও অভিহিত করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
এর বাইরে প্রধানমন্ত্রী সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। করোনা মহামারি, জলবায়ু সমস্যা, রোহিঙ্গা সংকট, নারী অগ্রগতি প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এ সব বৈঠকের আয়োজকদের মধ্যে ছিলেন। বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করেন প্রধানমন্ত্রী।
সঙ্গত কারণে জাতিসংঘে ২৪ সেপ্টেম্বর দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ৬টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেন বিশ্বনেতাদে সামন।
প্রথমত:করোনা মহামারিমুক্ত বিশ্ব গড়তে সার্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত: শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ কমানো ও ক্ষতিপূরণ প্রদান।
তৃতীয়ত: করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ করা।
চতুর্থত: স্বল্পোন্ন দেশগুলোর টেকসই উত্তরণে সহায়তা প্রদান।
পঞ্চমত: প্রবাসী ও অভিবাসীদের প্রতি ন্যয়সঙ্গত আচরণ।
এবং ষষ্ঠত: মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন।
প্রধানমন্ত্রী তার প্রস্তাবে ধনী-দরিদ্র টিকা বৈষম্যের কথা তুলে ধরে বলেন, বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে এ যাবৎ বিশ্বে উৎপাদিত করোনা টিকার ৮৪ শতাংশই উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষ পেয়েছে। আর দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ পেয়েছে টিকার ১ শতাংশেরও কম। এ থেকে বোঝা যায় টিকা নিয়ে কতটা বৈষম্য ঘটেছে বা এখনো ঘটে চলছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে স্পষ্ট করে বলেন, বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে টিকার বাইরে রেখে কখনোই অর্থনীতির টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
তাই ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
করোনা মহামারির প্রকোপে শিক্ষাখাতে বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী এ খাতে বড় বিনিয়োগের পরামর্শ দেন। ইউনিসেফের তথ্য উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা জানান, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে দূরশিক্ষণের সক্ষমতা না থাকায় ওই সব দেশের শিক্ষার্থীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এ জন্য জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
করোনায় বিদেশে কাজ হারানো হাজার হাজার অভিবাসীর কর্মীর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ প্রত্যাশা করেন। আর মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে বিশ্বনেতাদের আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। কথার ফুলঝুরি না ছুটিয়ে বিশ্বনেতাদের এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে বলেন শেখ হাসিনা।
ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তান প্রসঙ্গও বাদ যায়নি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে। বরাবরের মতোই ফিলিস্তিনের প্রতি যে কোনো অবিচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। আর আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আফগান জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশও পাশে থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।