বিশ্বব্যাপী মারাত্মক খরা ও ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের কারণে লাখ লাখ মানুষ বাড়িঘর ত্যাগ করেছে। আগামী কয়েক দশকে এসব গৃহহীন মানুষ ‘আধুনিক দাসত্ব ও পাচারের’ হুমকিতে পড়বে। নীতি ও কর্ম গবেষণা সংস্থা- ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইইডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ তথ্য জানিয়েছে। এ ছাড়া, একাধিক গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাদক ও অস্ত্রপাচারের পর মানবপাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। দেশে দেশে যুদ্ধ ও সহিংসতার পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারি এ পরিস্থিতিকে আরও বেশি সংকটাপন্ন করে তুলেছে। সম্প্রতি দেশি বিদেশি গণমাধ্যমে এ খবর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিস্তারিত থাকছে আজকের সংবাদ পর্যালোচনায়।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে। এর মধ্যে অসংখ্য বাংলাদেশি রয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এ সময়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
আইআইইডির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু সংকট, তীব্র বন্যা, খরা, দাবানলসহ চরম আবহাওয়ার বিপর্যয়ের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার ওপর ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে তাঁরা আরও বেশি দাসত্বের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
আইআইইডি ও দাসপ্রথা-বিরোধী সংস্থার গবেষকেরা বলেন, উত্তর ঘানায় তীব্র খরার কারণে তরুণ জনগোষ্ঠী শহরের দিকে ছুটছেন। কুলি-মজুরের কাজ করা অনেক নারী পাচার হয়েছে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ঋণের কারণে নিজেদের বিক্রি করা আধুনিক দাসত্বের নতুন পথ তৈরি করেছে। বিপুল দেনা পরিশোধের জন্য কর্মীকে কাজের চক্রে বেঁধে রাখা হয়।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জানায়, সারা বিশ্বে ২৭ মিলিয়ন মানুষ নানাভাবে দাসত্বের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশেই রয়েছে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন আধুনিক দাস। সরকারি হিসাবমতে, প্রতিবছর ১৪ থেকে ১৭ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকছে এবং বাধ্যতামূলক শ্রম বা দাসত্বের শিকার হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু সংকটের প্রভাব যেমন ফসলহানি, পানির অভাব ও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিতে আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, লাতিন আমেরিকার ৬টি অঞ্চলে ২ কোটি ১৬ লাখ মানুষকে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে।
এদিকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার ও বাধ্যতামূলক শ্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র অতীতে দাস-প্রথা ও দাস-ব্যবসা চালু করেছিল এবং রেড ইন্ডিয়ানদের গণহত্যা করেছিল। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে মানবপাচার ও বাধ্যতামূলক শ্রমের অবস্থাও গুরুতর।
বিগত পাঁচ বছরে বাধ্যতামূলক শ্রমে লিপ্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মোট এক লাখ মানুষ বিক্রি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অর্ধেক বিভিন্ন পরিবারে বাধ্যতামূলক কাজে জড়িত রয়েছে। এখনও যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় পাঁচ লাখ শিশু শ্রমিক আছে, যারা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকে। তাদের মধ্যে অনেক শিশু ১০ বছরেরও নিচে। তারা প্রতি সপ্তাহে টানা ৭২ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হয়। তা ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ৪০ হাজার থেকে ৩ লাখ ২৫ হাজার নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনে শিকার হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, গোটা ইউরোপে বিশাল এক শ্রমদাসের রাজত্ব তৈরি হয়েছে। স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মূলত তথাকথিত উদারনীতির কথা বলে দরিদ্র্য মানুষজনকে আধুনিক দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিভিন্ন দেশে নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করার মাধ্যমেই আধুনিক দাস বানিজ্য থেকে জনগণকে রক্ষা করা সম্ভব।