করোনায় কোনমতে বেঁচে গেলেও ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার আতঙ্ক এখন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। করোনা মাহমারির দ্বিতীয় ঢেউ অনেকটা প্রশমিত হয়ে এসেছে। গত কিছুদিন ধরে সংক্রমণ হার ৫-৬ শতাংশে এদিকে-ওদিকে। দৈনিক মৃত্যুও কমে ৫০-এর কমবেশি। করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে খানিকটা হাঁফ ছাড়ার মতো অবস্থায় এখন দেশের মানুষ- যদিও গাছাড়া ভাবে ফের সংক্রমণ বাড়ার এবং তৃতীয় ঢেউয়ের সতর্কবার্তা রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
করোনা মহামারির মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রকোপে দিশেহারা রাজধানীর মানুষ। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি হচ্ছেন রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে। সরকারি হিসেবে চলতি বছর ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬০ জন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ৫৯ জন। এর মধ্যে আগস্টেই মারা যান সর্বোচ্চ ৩৪ জন। আক্রান্ত ও মৃতদের মধ্যে ৯০ ভাগের বেশি রাজধানীতে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৪ হাজার ২০৪ জন। এখনো হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১২-শো’র বেশি রোগী। এদের মধ্যে ৯৯০ জনই রাজধানী ঢাকায়।
এ সব তথ্যউপাত্তে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। তবে, আশঙ্কার কথা হচ্ছে এটি ডেঙ্গুর প্রকোপের প্রকৃত চিত্র নয়। রাজধানীর ৪১টি হাসপাতালের তথ্য-উপাত্তে পাওয়া একটি খণ্ডচিত্র এটি।
ডেঙ্গুর প্রকৃত অবস্থার কাছাকাছি একটি চিত্র উঠেছে ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ডেঙ্গু বিষয়ক এক সেমিনারে। ‘নগরীর মশা নিবারণে সমস্যা: টেকসই সমাধানের একটি রূপরেখা’ শীর্ষক ওই সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা চমকে ওঠার মতো তথ্য দিয়েছেন। তারা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সরকারের দেয়া সংখ্যার কমপক্ষে ২০ গুণ বেশি! অর্থাৎ দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তে সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণা উদ্ধৃত করে তারা বলছেন, একজন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানে ২০ থেকে ৪০ পর্যন্ত এতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর সর্বনিম্ন ২০ জন ধরলেও এ সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এ থেকে বোঝা যায় ডেঙ্গুরা ভয়াবহতার চিত্র। আর যেখানে খোদ রাজধানীর হিসাবটাই আমাদে কাছে নেই সেখানে সারাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া একরকম অসম্ভব প্রায়।
গত ক’বছর ধরে ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই আমাদের। ডেঙ্গু সিজন শুরু হলে নগরের দুই মেয়র গণমাধ্যমকে নিয়ে এডিসে লার্ভা নির্মূলে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেন। বাসাবাড়িতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করেন, মানুষজনকে জরিমানা করেন-কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় না। দুই সিটিতে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডগুলোতে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছেই। বন্ধ জলাশয় ও বর্জ্যফেলার স্থানগুলো এডিসের উৎসস্থলে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরজুড়ে মশা নিধনে কাজ না করা,ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা না করেই লোক দেখানো পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কারণে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না ডেঙ্গু। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভুক্তভোগীরা তো হরহামেশাই করে আসছেন এমন অভিযোগ।
এডিস নির্মূলে ব্যর্থতার জন্য চারটি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এক. জাতীয় লক্ষ্য না থাকা, দুই.সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকা,তিন. সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা না থাকা এবং চার. সর্বোপরী যথাযথ নির্দেশনা ও বাস্তবায়নে খামতি।
মশা নিয়ন্ত্রণে যে মশার ওষুধ ছিটানো হয় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সেটির কার্যকারিতা নিয়ে অতীতে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। তাই, মশার ওষুধ কেনার সময় কার্যকর ওষুধ কেনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে গণমশারি বিতরণ কর্মসূচি চালুর পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।
এ অবস্থায় লার্ভা নির্মূল না করতে পারার দায় নগরবাসীর ওপর না চাপিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে এর টেকসই সমাধান প্রয়োজন বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদরা।
রাজধানীবাসীসহ সারাদেশের মানুষের প্রত্যাশা বিশেষ- বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নিয়ে সরকার ডেঙ্গু নির্মূলে একটি নীতিমালা ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।