চীনে উন্নয়ন গ্রামের গল্প
2021-09-15 14:09:39

সি ছুয়ান প্রদেশের ইয়া আন শহরের ‘ফা চান’ নামে একটি গ্রাম রয়েছে। চীনা ভাষায় ‘ফা চান’ মানে উন্নয়ন। এই গ্রামে কৃষকদের দুটো গ্রুপ আছে। তাদের নাম যথাক্রমে স্বর্ণ পাহাড় ও রূপা পাহাড়। নাম দুটি স্থানীয় একটি পাহাড়ের সাথে সম্পৃক্ত। পাহাড়ের যে দিকটায় সূর্যের আলো পড়ে- সেটিকে স্বর্ণ পাহাড় এবং পেছনের দিক তুষারে ঢাকা থাকার কারণে তাকে রূপা পাহাড় বলা হয়।

পাহাড়ে গাছ কাটা ছিল গ্রামের বাসিন্দাদের মূল কাজ। তেপ্পান্ন বছর বয়সী হুয়াং হুয়ে পিং তার ১৭ বছর বয়স থেকে গাছ কাটতে শুরু করেন। তিনি বলেন, নতুন গাছ বড় হবার আগেই বাকি সবগাছ কাটা হয়ে যেতো। অতিরিক্ত গাছ কাটার কারণে এখানের জমিতে পানি হ্রাস পায়। ফলে বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়তো। এমনাবস্থায় ১৯৯৮ সাল থেকে সিছুয়ান প্রদেশে চালু হয় প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ প্রকল্প। এ ধরণের প্রকল্প চীনে এটিই প্রথম। এর কারণে যারা আগে গাছ কাটতেন, তারা এখন গাছের রক্ষকে পরিণত হয়েছেন।

তা ছাড়া, কয়লা খনি ছিল স্থানীয়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবসা। চুয়ান্ন বছর বয়সী বাসিন্দা থাও ইউং হু এক সময় একটি কয়লা খনির দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি জানান, ১০-১২ বছর আগে সেখানে বড় ও ছোট কয়লা খনির সংখ্যা ৫০টির বেশি ছিল এবং কেবল উন্নয়ন গ্রামে কয়লা খনির সংখ্যা ছিল ১০টির বেশি। তার খনিতে প্রতিবছর মাত্র ২০ হাজার টন কয়লা উত্পাদিত হতো এবং তার গুণগতমানও ভাল ছিল না। কর্মীদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে যেত এবং খনিতে দুর্ঘটনাও ঘটতো। তবে ২০০৮ সালে সেখানকার কয়লা হ্রাস, নিরাপত্তা, ও পরিবেশ সংরক্ষণের কারণে স্থানীয় খনিগুলো বন্ধ করা হয়।

এক সময় ‘ উন্নয়ন’ গ্রামের উন্নয়ন বন্ধ ছিল। স্বর্ণ ও রূপা নামের দুটি গ্রুপসহ সকল বাসিন্দাদের আয় কমে যায়। কয়লা ও গাছ কাটা টেকসই উন্নয়ন আনতে পারেনি। ফলে তারা নিজেদের জীবনযাত্রার ধরণ পরিবর্তন করেন।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, পরিষ্কার পানি ও সবুজ পাহাড় মানে স্বর্ণ ও রূপা। উন্নয়ন গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব ভাল, সারা জেলার মোট আয়তনের শতকরা ৮০.৩ ভাগই বনাঞ্চল। প্রেসিডেন্ট সির কথার মর্মার্থকে ধারণ করে স্থানীয় সরকার সবাইকে গ্রামীণ পর্যটন ব্যবসায় উত্সাহ দেয়। তবে কেউ কেউ ভাবতে থাকেন, তারা দীর্ঘ সময় ঐতিহ্যিক শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং পর্যটন ব্যবসার কোন অভিজ্ঞতা তাদের নেই। যদি বিনিয়োগ ব্যর্থ হয়, তাহলে কী করবেন? তাদের এমন ভাবনা দূর করে আত্নবিশ্বাসী করে তুলতে গ্রামের প্রধান লি হু লিন সবার আগে গ্রামীণ পর্যটন ব্যবসা শুরু করেন।

গ্রামের বাসিন্দা হুয়াং হুয়ে পিং স্বচোখে দেখেন প্রতিবেশী গ্রাম গ্রামীণ পর্যটনের মাধ্যমে উন্নয়ন করছে। তিনিও সিদ্ধান্ত নেন, এক লাখের বেশি ইউয়ান বিনিয়োগ করে নিজের পুরাতন বাড়িঘরকে পারিবারিক হোটেলে রূপান্তর করার। প্রথম বছর তার নিট আয় ৩০ হাজার ইউয়ান ছাড়ায়।

গ্রামের আরেক বাসিন্দা চৌ হং ১৯ বছর বয়সে  গ্রাম ছেড়ে চলে যান। তখন গ্রামে কোন সুন্দর ভবন ছিল না, চাষ ক্ষেত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কাঁচা রাস্তায় হেঁটে শহরে যান তিনি । কিন্তু ২০১৫ সালে যখন তিনি গ্রামে ফিরে আসেন, তখন তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি, তার গ্রাম দেখতে পুরোপুরি অন্য রকম হয়ে যায়। পাকা রাস্তা ধরে গ্রামে ফিরেন তিনি। তার বাবা-মাকে নিয়ে তিনি গ্রামীণ পর্যটন ব্যবসা শুরু করেন। আর কখনো গ্রাম না-ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

পান্ডা সংরক্ষণের জন্য ২০১৭ সালে চীনে চালু হয় জাতীয় পার্ক ব্যবস্থা। উন্নয়ন গ্রামটিও বন্য পান্ডা অধ্যুষিত এলাকার অন্তর্ভুক্ত। গ্রামবাসীরা পাহাড় থেকে বাঁশ এনে জীবিকা নির্বাহ করলেও তাতে একসময় বাধা পড়ে। কারণ পান্ডার জন্য একটি জায়গা ছেড়ে দিতে হয় তাদের। ফলে গ্রামবাসীরা আবারও তাদের জীবনে পরিবর্তন আনেন। এবার তারা ‘প্রবেশ সম্প্রদায়’ নামে একটি ধারণার সঙ্গে পরিচিত হন।

তার মানে পান্ডা সংরক্ষণ জাতীয় পার্কের প্রবেশদ্বার কমিউনিটি। সেখানে প্রজাতি সুরক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পর্যটন ইত্যাদি সব উন্নয়ন হতে পারে। জাতীয় পার্কের প্রবেশদ্বার কমিউনিটিতে পরিণত হয় উন্নয়ন গ্রাম। স্থানীয় অবকাঠামো পূর্ণাঙ্গরূপে গড়ে তুলো হয় এবং গ্রামকে পান্ডা থিমের একটি পারিবারিক হোটেলের বিশেষ একটি গ্রামে পরিণত করা হয়।

২০১৭ সালে হুয়াং হুয়ে পিং নতুন করে কয়েকটি বাড়িঘর নির্মাণ করেন। প্রতিটি রুমে একটি টয়লেট নির্মাণ করেন। তার সঙ্গে বারান্দাও রাখেন। এখন তার বার্ষিক আয় দুই লাখ ইউয়ান।

বর্তমানে উন্নয়ন গ্রামে আপনারা নানা স্টলের পারিবারিক হোটেল দেখতে পাবেন। গ্রামের বাসিন্দাদের মাথাপিছু নিট বার্ষিক আয় ২০১৬ সালের ৮,০০০ ইউয়ান থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ২০ হাজার ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে।

এক সময় গাছ কাটতেন ও কয়লা খনিতে কাজ করতেন হুয়াং হুয়ে পিং। তিনি এখন পারিবারিক হোটেলের মালিক। গ্রামের উন্নয়ন তার জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। তাই সবুজ পাহাড় ও পরিষ্কার পানি এখন তার কাছে সত্যিই স্বর্ণ ও রূপায় পরিণত হয়েছে। (শিশির/এনাম/রুবি)