আবার আসছে অ্যাকোর্ড, কীভাবে নিচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক মালিক ও শ্রমিকরা
2021-09-09 20:46:25

আজহার লিমন, ঢাকা: ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে ১ হাজার ১০০ পোশাক শ্রমিকের নির্মম মৃত্যুর পর, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় জোটবদ্ধ হয় তৈরি পোশাকের পশ্চিমা ক্রেতারা। পোশাক শ্রমিকদের অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্মিলিত একটি চুক্তি করে নেদারল্যান্ডের হেগ শহর থেকে বাংলাদেশ অ্যাকর্ড ফাউন্ডেশন নামে যাত্রা শুরু করে পশ্চিমা ক্রেতা বা ব্রান্ড-বায়ারদের ঐ জোট, যেটি অ্যাকর্ড নামেই বেশি পরিচিত। ঘোষণা দেওয়া হয়, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কারাখানাগুলোর সংস্কারে কাজ করবে অ্যাকর্ড। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে আবার ফেরত যাবে তারা। তবে কার্যক্রম গোটাতে ২০১৭ সালে আবার একটি চুক্তি করে অ্যাকর্ড, চলতি বছরের মে'তে যার মেয়াদ শেষ হয়।

আবার আসছে অ্যাকোর্ড, কীভাবে নিচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক মালিক ও শ্রমিকরা_fororder_jing4

এর মধ্যে সরকারের তত্ত্বাবধানে আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল-আরএসসি নামে একটি স্বাধীন কাউন্সিল গঠিত হয় বাংলাদেশে। কথা ছিলো অ্যাকর্ডের নীতি ও পরিকল্পনাসহ  শ্রমিকদের অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে কাজ করবে এ ফোরাম। কিন্তু এরই মধ্যেই নতুন করে চুক্তি নবায়ন করেছে অ্যাকর্ড।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড নামে আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও শ্রম অধিকার সংগঠনের মাঝে সম্পাদিত ঐ চুক্তির মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও সংগঠন করার স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করতে চায় বলছে স্বাক্ষরকারীরা। আর এ নিয়েই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষগুলোর মধ্যে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ পরিচালক আসিফ ইব্রাহিম মনে করেন, নতুন করে বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের আসার কোন প্রয়োজন নেই। যদিও তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন শ্রমিক অধিকার নেত্রী নাজমা আকতার।

আবার আসছে অ্যাকোর্ড, কীভাবে নিচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক মালিক ও শ্রমিকরা_fororder_jing5

ছবি: আসিফ ইব্রাহিম, সদস্য, বোর্ড অব ডিরেক্টর, বিজিএমইএ

বিজিএমইয়ের এই নেতা বলেন, “ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকোর্ডর সিগনেটর হচ্ছে ব্রান্ডস এবং ট্রেড ইউনিয়ন, সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে যেখানে আমাদের এজেন্ডা ছিলো ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ফায়ার সেফটি সেখানে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকোর্ড ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে কিংবা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের সঙ্গে কী করণে চুক্তি করলো।”

: ওরা বলছে যে, শ্রমিকদের অধিকার ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তারা কাজ করবে?

বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের শ্রম আইন আছে। মিনিস্ট্রি অব লেবারের ইমপ্লোয়মেন্ট আছে, অ্যাসোসিয়েশন আছে, বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন আছে এবং ইনডিভিজ্যুয়াল ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেটরি কমিটি আছে।”

: তার মানে আপনারা মনে করছেন, অ্যাকোর্ড বা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকোর্ডের দরকার নেই?

এ ব্যাপারে বিজিএমইয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা তো মনে করছি আরএসসিই সাফিসিয়েন্ট। যে কারণে অ্যাকোর্ড করা হয়েছিলো তার জন্য আরএসসি সাফিসিয়েন্ট। আমরা তো মনে করি না যে এখানে অন্য একটা কিছু আসার প্রয়োজনীয়তা আছে।”

আবার আসছে অ্যাকোর্ড, কীভাবে নিচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক মালিক ও শ্রমিকরা_fororder_jing6

ছবি: শ্রমিক অধিকার নেত্রী নাজমা আকতার

যদিও জনাব আসিফের এই বক্তব্যকে অযৌক্তিক মনে করছেন শ্রমিক অধিকার নেত্রী নাজমা আকতার। তিনি বলেন, “একের পর এক বিল্ডিং ধস, অগ্নি দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের জীবন দিতে হচ্ছে। তাই অ্যাকোর্ডের প্রয়োজন আছে। এখন যেটা আসছে সেটা আরও ভালোভাবে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, যেভাবে কাজ করলে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি আছে বা কাজ করলে অসুখ হয় সেগুলো নিরোসন হবে।

কিন্তু পক্ষগুলোর মধ্যে এই আস্থার সংকট আর বিপরীতমুখি অবস্থানে কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের পোশাক খাতে? আর শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে আলাদা মন্ত্রণালয় ও আইন থাকার পরও কেন প্রয়োজন পড়ছে বিদেশি পক্ষের? সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় ক্রেতাদের নিজেদের মধ্যে জোটবদ্ধ হওয়ায় ক্ষেত্রে কোন বাঁধা নেই।

আবার আসছে অ্যাকোর্ড, কীভাবে নিচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক মালিক ও শ্রমিকরা_fororder_jing7

ছবি: সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

তিনি বলেন, আমরা মনে করি অ্যাকোর্ড যদি আলাপ আলোচনা শুরু করেন। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। আরএসসির কাঠামোর ভিতরে এই সমস্ত কার্যক্রমের আলোচনা শুরু করেন সে দিক থেকে উভয়পক্ষের ভেতরে পার্থক্য কমে আসবে এবং সরকারের সঙ্গেও যদি যৌথভাবে তারা আলাপ আলোচনা করেন ভোক্তা এবং শ্রমিকদের সঙ্গে মিলে  তখন হয়তো সমাধানের একটা পথ বেড়িয়ে আসবে।

: কিন্তু অনেক দেশেই তো অ্যাকোর্ড কাজ করে না। তাছাড়া আমাদের দেশে শ্রম মন্ত্রণালয় আছে, শ্রমিকদের জন্য আলাদা আইন আছে। এভাবেও কি আসলে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত সম্ভব নয়? অ্যাকোর্ডই কেন লাগবে?

এ ব্যাপারে সিপিডির এই গবেষক বলেন, “আসলে সীমিত আকারে অ্যাকোর্ডভুক্ত দেশ যেগুলো থেকে ব্রান্ড এবং বায়ারা পণ্য নিয়ে থাকে, সেসব দেশে সীমিত আকারে হলেও এসব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তবে একই সাথে এটাও ঠিক যে,  বাংলাদেশে যে মাত্রায় বা যেভাবে তারা কাজ করছে আমরা সে ধরনের উপস্থিতি আমরা অন্য দেশে দেখতে পাই না। আমরা মনে করি অ্যাকোর্ড ইন্টারন্যাশনালের উচিত হবে বাংলাদেশে যে মাত্রায় তারা কার্যক্রম পরিচালিত করছে সে মাত্রায় বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোতেও যাতে করে।”

এরই মধ্যে স্বাক্ষরকারী ১০৪ টি ব্যান্ড ও বায়ারদের তালিকা প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড। এখন সামনের দিনগুলোতে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিক, সরকার ও বিদেশি জোটসহ পক্ষগুলো কতটা নিবিড়ভাবে কাজ করছে তারওপর নির্ভর করছে শ্রমিকদের অধিকার তথাপি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক খাতের ভবিষতও।