গত ৫ সেপ্টেম্বর পালিত হয়েছে ষষ্ঠ চীনা দাতব্য দিবস। চলতি বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘দাতব্য কাজের মাধ্যমে গ্রামীণ পুনরুদ্ধারকে সাহায্য করা’।
গত জুলাই মাসে চীনের হ্য নান প্রদেশে বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা হয়। তাতে নানা জায়গা গুরতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা প্রতিরোধ ও দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় মানুষকে সাহায্য দেয়ার উদ্দেশ্যে চীনে দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে নানা রকম দান কার্যক্রম চালু হয়েছে। এর আওতায় গত ২ আগস্ট পর্যন্ত সারা চীন থেকে হ্য নান প্রদেশকে মোট ৬০১.২ কোটি ইউয়ান এবং ৩৮.১ কোটি ইউয়ান মূল্যের সামগ্রী দান করা হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাদার তেরেসা মারা যান। তার স্মরণে জাতিসংঘ প্রতি বছর এ দিনকে বিশ্ব দাতব্য দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেছে। ২০১৬ সালে চীনে প্রয়োগ ও চালু হয় ‘দাতব্য আইন’। এতে প্রতি বছরের ৫ সেপটেম্বর চীনা দাতব্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
চীনা দাতব্য প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, ২০১৮ সালে চীনে নগদ অর্থ এবং নানা সামগ্রীর দানের মোট মূল্য ছিল ১২,৭০০ কোটি ইউয়ান। এর ৭০ শতাংশ হল নগদ অর্থ। ২০১৯ সালে সারা চীনে দানের মোট অর্থ মূল্য ছিল ১৩,৩০০ কোটি ইউয়ান। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতি বছর চীনে দাতব্য দানের মোট অর্থ মূল্য ১০,০০০ কোটি ইউয়ানের বেশি হচ্ছে। সেচ্ছায় সেবা ও দান ব্যবস্থাপনাসহ নানা ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
চিকিত্সা ও স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র্যবিমোচন--এ তিন খাতে সবচেয়ে বেশি দান হয়। ফোর্বস ম্যাগাজিনের চীনা সংস্করণের ২০১৮ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠাতা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থ দান করেন বা সেখানে বিশেষ শিক্ষা তাহবিল স্থাপন করতে পছন্দ করেন। যদি কোন প্রাকৃতি দুর্যোগ না-হয়, তাহলে দানের বেশির ভাগ অর্থ দারিদ্র্যবিমোচনে যায়। তবে গত বছর কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় দাতব্য বড় ভূমিকা পালন করেছে।
অর্থনীতি, সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের দাতব্য চেতনাও বাড়ছে। চীনা ভাষায় দাতব্যকে বলা হয় ‘ছি শান’। ছি মানে নিঃস্বার্থ যত্ন ও সমর্থন এবং শান মানে আন্তরিক ভালবাসা ও বন্ধুত্ব। অন্যদের সাহায্য দেয়া হল চীনা জাতির ঐতিহ্যর অন্যতম।
অধিকাংশ দান দাতব্য সংস্থায় পাঠানো হয়। ২০১৮ সালে তহবিল সংস্থা ও দাতব্য সংস্থা যথাক্রমে ৬৪৫৯ কোটি ইউয়ান ও ৩৩০১ কোটি ইউয়ান দান পেয়েছে। অন্য সামাজিক সংস্থা, সরকারি বিভাগ ও ব্যবসায়িক ইউনিটও দান গ্রহণ করতে পারে। পাশাপাশি সরকার, সামাজিক সংস্থা ও গণতান্ত্রিক পার্টি দান যেমন গ্রহণ করতে পারে, তেমনি নিজেরাও দান করতে পারে।
উপাত্ত অনুযায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠান সবসময় বৃহত্তম দানকারী। তবে ব্যক্তিগত দানের অনুপাত ২০১৪ সালের ১১ শতাংশ থেকে ২০১৮ সালের ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ব্যক্তিগত দানের বৃদ্ধি মানুষের দানের চেতনা বৃদ্ধির প্রমাণ।
উন্মুক্ত, সুবিধাজনক ও কম খরচের ইন্টারনেটের সাহায্যে নেটিজেনরা আরও বেশি অনলাইন দাতব্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে টেনসেন্ট ও আলিবাবাসহ ১২টি প্ল্যাটফর্মকে প্রথম অনলাইন দান প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নির্ধারণ করে চীনের বেসামরিক প্রশাসন মন্ত্রণালয়। মাত্র এক বছরে ১২টি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দানের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫৯ কোটি ইউয়ানে। ২০১৯ সালের সেম্টেম্বর মাসে টেনসেন্ট প্ল্যাটফর্মে চালু হয় ‘নয় সেপ্টেম্বর’ দাতব্য দিবস অনুষ্ঠান এবং তিনদিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৪.৮ কোটি মানুষ অনলাইনে ১৭৮ কোটি ইউয়ান দান করেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে চীনে অনলাইন দান প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৫৪০ কোটি ইউয়ান দান হয়, তা ২০১৯ সালের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেশি।
ডিজিটাল প্রযুক্তি চীনের দাতব্য শিল্পকে পরিবর্তন করছে। দাতব্য প্রকল্প ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যবধান কমছে। অলাইন দাতব্যের ফলে এটি এখন আর কোন জটিল কাজ নয়, বরং যে কেউ এতে অংশগ্রহণ করতে পারে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনে চালু হয় জাতীয় দাতব্য তথ্য প্ল্যাটফর্ম। এখানে দাতব্য সংস্থা, দাতব্য প্রকল্পসহ সবার তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় দাতব্য সংস্থার ৯৩৭০টি তথ্য, ও ৬৩২টি দাতব্য ট্রাস্ট ফাইলিং তথ্য। তার সঙ্গে জড়িত লেনদেনের মোট পরিমাণ ৩৪৮ কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার ইউয়ান বলে জানানো হয়।
ডিজিটাল যুগে এসে দাতব্য শিল্প আরও উন্মুক্ত, ও স্বচ্ছ হয়েছে। সামাজিক আস্থাও বেড়েছে। দাতব্য কাজের উপর মানুষের আস্থা বাড়ানোর সাথে সাথে অনলাইনে আরও বেশি দান বেড়েছে।
ছি শান হলো প্রত্যকের মনে লালিত এক ধরনের সবচেয়ে নিঃস্বার্থ ও উত্সর্গকৃত আত্মা। নিজের পরিবার ও অন্য পরিবারের প্রবীণদের সমানভাবে সম্মান করার ব্যাপক এতিহ্য রয়েছে চীনে। নিজের বাচ্চাদের মতো করেই অন্যের বাচ্চাদের যত্ন নেয়ায় অভ্যস্ত চীনারা। তারা মনে করেন, ‘আমাদের ছোট একটি সদয় আচরণ, অন্যদের জন্য বড় সাহায্য হতে পারে’। (শিশির/এনাম/রুবি)