৩০ বছর ধরে শিক্ষাদানে সহায়তার গল্প
2021-09-07 16:26:21

৩০ বছর ধরে শিক্ষাদানে সহায়তার গল্প

৩০ বছর ধরে শিক্ষাদানে সহায়তার গল্প_fororder_jiao1

সেপ্টেম্বর মাসে চীনের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সেমিস্টার শুরু হয়। চীনের ইয়ুননান প্রদেশের লি চিয়াং শহরের নিংলাং ই জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলায় নতুন ২০জন শিক্ষক এসেছেন। তাঁরা দুই হাজার কিলোমিটার দূরের চিয়াংসু প্রদেশের হাই আন শহর থেকে ফিরে এসেছেন।

 

আগে এই এলাকাটি ছিল খুব গরীব এবং শহর থেকে বহু দূরের এলাকা। আর হাই আনের স্থানীয় লোকজনের কাছে শিক্ষকতা খুব মর্যাদাপূর্ণ পেশা। শিক্ষকরা হলেন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। ৩০ বছর ধরে হাই আন শহর এই ই জাতি জেলার শিক্ষা মান উন্নয়নে সাহায্য দিয়ে আসছে। ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চিয়াংসু প্রদেশ হাই আনে ১০ দফার ২৮৫জন শিক্ষক পাঠিয়েছে। এভাবে ছোট এই জেলায় শিক্ষাদানের কাজে সাহায্য দেওয়া হয়েছে।

 

৩০ বছরেরও বেশি সময় হাই আনের শিক্ষকরা স্থানীয় মালভূমির খারাপ আবহাওয়া, অপরিচিত পরিবেশ, ভাষাগত বাধা এবং ভিন্ন জীবনধারার জটিল সমস্যা কাটিয়ে নিংলাং জেলায় শিক্ষার কাজে অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁদের সাহায্যে স্থানীয় ২০ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছে। আরো ১০ সহস্রাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। যা স্থানীয় অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নে শক্তিশালী সমর্থন দিয়েছে।

৩০ বছর ধরে শিক্ষাদানে সহায়তার গল্প_fororder_jiao2

৩৩ বছর ধরে ‘নিংলাং ও হাই আনের প্রতিশ্রুতি’ বাস্তবায়ন করা

সম্প্রতি ১৯ বছর বয়সী নিংলাং জেলার জাতিগত স্কুলের ছাত্র সু ওয়েন চিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে জেলার বাইরের প্রতিষ্ঠানে নতুন সেমিস্টারের জন্য প্রস্তুতি নেয়। সে বিমানের টিকিট কেটেছে, স্থানীয় বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করেছে এবং নতুন পোশাক কিনেছে। কারণ, মাত্র কয়েকদিন আগে সে চীনের প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়- ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়।

 

সু-এর বাসা নিংলাং জেলার ফেংজিইয়ান গ্রামে। তাঁর বাবা মা কৃষক, ছোট ভাই ও ছোট বোন স্কুলে লেখাপড়া করছে। স্থানীয় সরকার ও সমাজের হৃদয়বান মানুষের সাহায্যে পুরো পরিবার গত বছর সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছিল।

 

সু মনে করে, নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনের পেছনের কারণ হলো- হাই আনের শিক্ষকদের যত্ন ও ভালোবাসা। হাই আন থেকে আসা শিক্ষক মেই দ্য চুন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির খবর শুনে ব্যক্তিগতভাবে তাকে এক হাজার ইউয়ান উপহার দেয়। সু বলে, হাই আন থেকে আসা শিক্ষকরা তাদের খুব যত্ন নেন, লেখাপড়া থেকে শুরু করে জীবনের ছোট-বড় সব কাজে শিক্ষকরা গুরুত্বারোপ করেন। শিক্ষকদের যত্ন ছাড়া সে এত ভালো ফলাফল করতে পারত না।

 

নিংলাং জেলা ও হাইআন শহরের বিশেষ সম্পর্ক তিন দশক আগে শুরু হয়েছিল

নিংলাং জেলা ইয়ুননান প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। জেলার ৯৮ শতাংশই পাহাড়ি অঞ্চল। এ অঞ্চলটি গড়পড়তা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮০০ মিটার উঁচু। আগে নিংলাং জেলায় গুরুতর দরিদ্রতার সমস্যা ছিল। এ কারণে স্থানীয় শিক্ষকতার কাজ আরো দুর্বল ও কঠিন ছিল।

৩০ বছর ধরে শিক্ষাদানে সহায়তার গল্প_fororder_jiao4

দারিদ্র্যবিমোচনের আগে অজ্ঞতা ও অনগ্রসরতার সমস্যা সমাধান করতে হয়। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে, নিংলাং জেলা এবং হাই আন শহর কাঠের বাণিজ্য করত, কীভাবে দু’পক্ষের সহযোগিতা আরো সম্প্রসারণ করা যায়- তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। দুই জায়গার কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন যে- তারা শিক্ষার কাজে সহযোগিতা করবে।

 

১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে, নিংলাং ও হাইআন শিক্ষা সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি অনুযায়ী, দু’জায়গা যৌথভাবে একটি মাধ্যমিক স্কুল নির্মাণ করবে। এর নাম দেওয়া হয় ‘নিংহাই মাধ্যমিক স্কুল’। সেই বছরের অগাস্ট মাসে, হাই আন নিজের সমৃদ্ধ শিক্ষাগত সম্পদের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ৩৩জন ভালো মানের শিক্ষককে নিয়ে একটি শিক্ষা সহায়তাদল গঠন করে নিংলাং জেলায় পাঠায়।

তখন থেকে নিংলাং ও হাই আন সবার আগে চীনের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে শিক্ষা সহায়তা সহযোগিতা শুরু করে। যা এক একটি পাহাড়ি এলাকার শিশুর ভাগ্য পরিবর্তন করে দেয়।

 

যুগের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুই জায়গার সহযোগিতাও আরো উন্নত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে হাই আন শহর নিংলাং জেলার জাতিগত উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাদানে আরো বেশি গুরুত্বারোপ করে এবং ভালো মানের আরো অনেক শিক্ষক পাঠায়। ২০০৬ সালে হাই আনের শিক্ষা সহযোগিতা মৌলিক শিক্ষার পাশাপাশি পেশাদার শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ করা হয়।

 

সু যে ক্লাসে লেখাপড়া করে, এর নাম হলো ‘হাই আন ক্লাস’। এটি ২০১৬ সালের অগাস্ট মাসে দুই জায়গার শিক্ষা সহযোগিতার হাত ধরে তৈর হয়। এই ক্লাসের শিক্ষার্থীরা হলো নিংলাং জেলার নির্বাচিত শিক্ষার্থী, আর শিক্ষকরা হলো হাই আন শহরের নির্বাচিত বিভিন্ন বিষয়ের ভালো মানের শিক্ষক। তাই হাই আন ক্লাসে ভর্তি হওয়া স্থানীয় লোকজনের কাছে খুব গর্বের ব্যাপার।

 

৩৩ বছরে হাই আন শহর টানা ১০ দফায় মোট ২৮৫জন শিক্ষককে জেলাটিতে পাঠিয়েছে। এতে নিংলাং জেলার শিক্ষার মান অনেক বেড়েছে, অনেক শিশুর জীবন এ কারণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

৩০ বছর ধরে শিক্ষাদানে সহায়তার গল্প_fororder_jiao6

নিংহাই জাতির মাধ্যমিক স্কুল পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত। ১৯৮৮ সালের অগাস্ট মাসে প্রথম দফায় হাই আনের ৩৩জন শিক্ষক ট্রেন ও বাসে করে বহু কষ্টে দুই হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিংলাং জেলায় পৌঁছায়। শিক্ষকরা তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন, পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিন ভূমিধস হয়। সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পাথর, তাঁদের কাঠের বাড়িঘরও এতে বিধ্বস্ত হয়েছিল।

 

কাজের শুরুতে নিংলাং জেলা ছিল খুব দরিদ্র। হাই আনের শিক্ষক এবং স্থানীয় শিক্ষকরা সবাই একই রকমের কাঠের ঘরে থাকতো। তাঁদের পান করা পানিতে সবসময় মাটি ভাসতো, লোডশেডিং ছিল নিত্যসঙ্গী। তা সত্ত্বেও এসব শিক্ষক কখনওই অবহেলিত এলাকা ছেড়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেন নি।

 

হাই আনের শিক্ষকরা দরিদ্র এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার চিন্তাধারা ও পদ্ধতি নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে স্থানীয় ছাত্র ইয়াং ছাং হুয়া চীনের প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়- ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি হলেন হাই আন ক্লাসের প্রথম দফার ছাত্র। তিনি বলেন, হাই আন শিক্ষকরা প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি সম্মান জানান, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ভালো অভ্যাস গড়ে তোলেন, পরীক্ষার বিষয়বস্তু ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেন।

 

প্রথম দফায় হাই আন শিক্ষকরা তিন বছর শিক্ষকতা করেছিলেন। এরপর নিংহাই মাধ্যমিক স্কুলটি পুরো জেলায় শীর্ষ মাধ্যমিক স্কুলের মর্যাদা পায়। যা আগে কল্পনাও করা যেতো না। হাই আন থেকে শিক্ষকরা আসার আগে নিংলাং জেলায় শিক্ষা-দীক্ষার মান ছিল অনেক দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কোনো ছাত্রছাত্রী পাস করতো না।

 

শিক্ষার কাজ ছাড়া হাই আন শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের অনেক সাহায্যও করেছেন। গত বছরের অক্টোবর মাসে, হাই আন শহরের ছুইথাং মাধ্যমিক স্কুলে দাতব্য কাজের জন্য একটি মেলা আয়োজন করা হয়। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা নিজের জিনিস বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন করে, তা নিংলাং জেলার স্কুলের ২০জন দরিদ্র ছাত্রছাত্রীকে দান করা হয়।

 

ওয়াং লিন বো হাই আনের একজন শিক্ষক। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নিংলাং জেলায় শিক্ষাদানের কাজে সাহায্য দিতে এসেছেন। তাঁর মতো অনেক হাই আনের শিক্ষক সেখানে শিক্ষা-সংক্রান্ত কাজে গুরুত্ব দেন এবং নিংলাং জেলায় যান। ২০১০ সালের অগাস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষক ওয়াং ইয়ুং চুন প্রায় ১১ বছর ধরে এই দরিদ্র জেলায় কাজ করছেন। তাঁর সাহায্যে স্থানীয় শিক্ষকদের শিক্ষার মান অনেক বেড়েছে। তিনি মনে করেন, এভাবে তাঁর নিজের জীবনও তাত্পর্যময় হয়ে উঠেছে।

৩০ বছর ধরে শিক্ষাদানে সহায়তার গল্প_fororder_jiao5

সাংবাদিক যখন নিংলাং জেলায় যান, তখন দেখতে পান যে, জেলা থেকে দূরবর্তী গ্রাম পর্যন্ত, নতুন তৈরি কমিউনিটি থেকে স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন-সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাই আনের শিক্ষকদের দেখা যায়। আর স্থানীয় শিক্ষার্থীরা হাই আন শিক্ষকদের সাহায্য বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাসের পর নিজের জন্মস্থানে ফিরে আসেন এবং শিক্ষাদানের কাজে যোগ দেন।

 

নিংলাং জেলার দরিদ্র মানুষদের ভালো জায়গায় স্থানান্তরের জন্য নতুন তৈরি বাড়িঘরের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এসব কমিউনিটির মধ্যে ‘সুখী বাসা’ নামে এক কমিউনিটি আছে। এই কমিউনিটির প্রধান লু ইয়ুন হুয়া ৬৬০০ জনেরও বেশি স্থানান্তরিত মানুষের মনের কথা সাংবাদিককে জানান। যদি হাই আনের শিক্ষকরা না থাকতো, তাহলে স্থানীয় দারিদ্র্যবিমোচনের কাজ এত দ্রুত শেষ হতো না।

 

২০২০ সালের নভেম্বর মাসে নিংলাং জেলা সুষ্ঠুভাবে দারিদ্র্যমুক্তকরণের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে। এখন জেলাটি দেশের বাধ্যতামূলক শিক্ষা উন্নয়নের ভারসাম্যপূর্ণ জেলায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া জেলাটি ২৩.৭ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ দিয়ে অনেক নতুন স্কুল তৈরি করেছে। আগে জেলার শিক্ষার কাজ অনেক দুর্বল ছিল, কিন্তু এখন জেলাটি ইয়ুননান প্রদেশের শিক্ষা খাতের শক্তিশালী জেলায় পরিণত হয়েছে।

 

সাক্ষাত্কারে স্থানীয় স্কুলের প্রধান সাংবাদিককে জানান, আগের অবস্থা ছিল এমন- শিক্ষার্থীরা মাটির কক্ষে ক্লাস করতো। ছোট ক্লাসরুমে শুধু একটি ব্ল্যাকবোর্ড ছিল, শিশুদের আলো নিয়ে  স্কুলে যেতে হতো, অনেক শিশু লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো। তবে এমন দিন এখন ইতিহাসের অংশ।

 

আগের চেয়ে নিংলাংয়ের শিক্ষার মান অনেক বেড়েছে। তবে হাই আন শিক্ষকরা চলে যান নি। তাঁরা বলেন, শিশুদের জ্ঞানার্জনের আগ্রহ তাঁদের কাজের চালিকাশক্তি।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)