সমুদ্র তলে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে সামুদ্রিক রেশমপথ—পানির নিচের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চীন-বিদেশি বিনিময়ের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরে
2021-09-07 14:01:11

সমুদ্র তলে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে সামুদ্রিক রেশমপথ—পানির নিচের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চীন-বিদেশি বিনিময়ের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরে_fororder___172.100.100.3_temp_9500031_1_9500031_1_1_28cef2c0-c23a-4b4f-80f6-6ea996232701

‘নানহাই নং ১’ জাহাজের ধ্বংসাবশেষের গবেষণা থেকে “ছুয়ান চৌ: চীনের সোং ও ইউয়ান রাজবংশ আমলে বিশ্ব মহাসাগর বাণিজ্যকেন্দ্র” বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত পর্যন্ত,  পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, চীন নিজ দেশের পানির নিচে প্রত্নতত্ত্বের কাজ জোরদার করার সঙ্গে সঙ্গে, সক্রিয়ভাবে বিদেশে ও সমুদ্র তলদেশের প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধান কাজ করেছে। পানির নিচে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চীন-বিদেশি বিনিময়ের দীর্ঘ ইতিহাস নিশ্চিত করেছে।

 

স্থলভাগ ও সমুদ্র-সহ নানা স্থানে চীন-সৌদি আরব যৌথ স্যালিন বন্দর সাইটে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্প হলো চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ। এটি সামুদ্রিক রেশমপথ বরাবর দেশগুলোর মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। ‘আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সাইট’ কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, শানতুং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক চিয়াং বো হলেন চীন-সৌদি আরব প্রত্নতাত্ত্বিক দলের চীনা অংশের প্রধান। চিয়াং বো বলেন, এবার চীন-সৌদি আরবের যৌথ প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা ফলপ্রসূ হয়েছে। তিনি বলেন,

 

“২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত স্যালিন বন্দরে দু’টি প্রত্নতাত্ত্বিক তদন্ত ও খননকাজ করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে স্থলভাগ প্রত্নতাত্ত্বিক তদন্ত এবং ভূমিতে খনন কাজ, তা ছাড়া রিমোট এরিয়াল সেন্সিং প্রত্নতত্ত্ব এবং পানির নিচে প্রত্নতাত্ত্বিক কাজও করা হয়েছে। সামুদ্রিক রেশমপথের কুইকস্যান্ডে আচ্ছাদিত একটি বন্দরও আবিষ্কার করা হয়েছে। এতে সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্পর্কিত বিপুল সংখ্যক সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষও আবিষ্কার করা হয়েছে। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার হলো চীনের চীনামাটির বাসন। এতে দেখা যায় যে, সেই যুগে চীন ও লোহিত সাগরের মধ্যে প্রকৃত সামুদ্রিক খাতে বিনিময় হয়েছিল।”

 

চীন-সৌদি আরব যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক দলের সৌদি পক্ষের প্রধান মেদি কর্ণি বলেছেন, যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক ফলাফল চীন ও আরব দেশগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক ও আর্থ-বাণিজ্যিক বিনিময়ের দীর্ঘ ইতিহাসের সন্ধান দিয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে তাদের নিজস্ব ইতিহাস গবেষণা ও অধ্যয়নে সমৃদ্ধ উপকরণ সরবরাহ করেছে। মেদি বলেন, “সৌদি আরবের জনগণ হিসেবে আমরা চীনের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত এই সহযোগিতা প্রকল্পকে অনেক গুরুত্ব দিই। চীন থেকে লোহিত সাগর পার হওয়ার প্রাচীন বাণিজ্যপথ, অর্থাত্ সামুদ্রিক রেশমপথ সৌদি আরব-চীন সাংস্কৃতিক বিনিময় ও আর্থ-বাণিজ্যিক সহযোগিতাকে অনেক শক্তিশালী করেছে। আমাদের বর্তমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার এই সব প্রমাণ করেছে।”

 

পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব হলো স্থলভাগের প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার একটি সম্প্রসারণমূলক কাজ। এটি প্রত্নতত্ত্বের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণাপদ্ধতি ব্যবহার করে পানির নিচে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসন্ধান, অন্বেষণ, খনন ও গবেষণাকাজের অংশ। একই সময়, পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব একটি বহুমুখী শিক্ষার বিষয়। এজন্য সামুদ্রিক অনুসন্ধান প্রযুক্তি, ডাইভিং ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তির মতো অনেক প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন।

 

১৯৮০’র দশকে পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধানে চীন পিছিয়ে ছিল। কিন্তু ৩০ বছরেরও বেশি সময়ের চেষ্টার পর চীনের সমুদ্রে প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধানকাজ অনেক উন্নত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলির মধ্যে একটি হলো ‘নানহাই নং ১’ জাহাজের ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান ও গবেষণা। চিয়াং বো বলেন, “‘নানহাই নং ১’ জাহাজকে কুয়াংতুংয়ের সমুদ্রে পাওয়া গেছে, এটি ছুয়ান চৌ বন্দর থেকে রওনা হয়েছিল এবং কুয়াংতুংয়ে এসে ডুবে গেছে। জাহাজটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এমনকি ভারত মহাসাগরের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের মাধ্যমে ছুয়ান চৌ বন্দরের বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের দুর্দান্ত অবস্থা তুলে ধরে। এটি আমাদের প্রাচীন মহাসাগরীয় বাণিজ্যের বিবরণ খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। অন্য বিষয় হলো, আমরা আমাদের কাজ খুব সূক্ষ্মভাবে করি, এমনকি জাহাজে দক্ষিণ সোং রাজবংশের লোকদের চুলও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, প্রাচীন সমুদ্রবন্দর সাইট বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সময়ে তাদের সামুদ্রিক জীবনের অবস্থা কেমন ছিল। এটি ছুয়ানচৌ বন্দরের মতো আমাদের বোঝাপড়া ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে।”

 

পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধানের ফলাফল ছুয়ানচৌ বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী সমর্থন দিয়েছে, যা “ছুয়ান চৌ: চীনের সোং ও ইউয়ান রাজবংশ আমলে বিশ্ব মহাসাগর বাণিজ্যকেন্দ্র” বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য অনেক সহায়ক।

 

সামুদ্রিক রেশমপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে, সোং ও ইউয়ান রাজবংশ আমলের ‘প্রাচ্যের বৃহত্তম বন্দর’ হিসেবে ছুয়ানচৌ বন্দরে ‘সামুদ্রিক বাণিজ্য’ সম্পর্কিত অনেক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এবং পানির নিচে প্রত্নতত্ত্বের সাফল্য এই ঐতিহাসিক গল্পগুলিকে যুক্ত করছে।

 

চিয়াং বলেন, “আমরা ছুয়ানচৌ বন্দরের আশেপাশে তদন্ত চালিয়েছি, এবং লোহা গলানোর সাইট আবিষ্কার করেছি, দ্য হুয়া ভাটা ও ছিহুয়া ভাটা সাইটের মতো চীনামাটি রপ্তানির বাসন তৈরি করার সিরামিক সাইটও আবিষ্কার করেছি। এ ছাড়া, ছুয়ানচৌ বন্দর শহরে এখন শিল্প কর্মশালার অনেক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। যেমন, লোহার জিনিসপত্র এবং টিনের তৈরি স্থানগুলিকে ‘লোহার রাস্তা’ বা ‘টিনের রাস্তা’ বলা হয়। এই নামগুলি বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। তাই যখন আমরা ‘নানহাই নং ১’ জাহাজের পানির নিচের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মধ্যে প্রাচীন বার্নিশ বা টিনের তৈরি জিনিসপত্র দেখি, তখনই আমরা ছুয়ানচৌ বন্দরে হস্তশিল্পের কর্মশালার কথা ভাবি। অতএব এটা বলা যেতে পারে যে, পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব সমুদ্রবন্দর সম্বন্ধে আমাদের বোঝাপড়া অনেক সমৃদ্ধ করেছে, যা খুবই অর্থপূর্ণ ও মূল্যবান।”

 

চিয়াং বো বলেন, এখন পর্যন্ত চীনের ৮টি ব্যাচের ১০০জনেরও বেশি পেশাদার ব্যক্তিকে পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধানে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যার মধ্যে ৮জন বিদেশি।

চিয়াং বো বলেন, “চীনের পানির নিচে প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রশিক্ষণ ৮টি সেশনে আয়োজন করা হয়েছে। ১০০জনেরও বেশি পেশাদার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে দুইজন কেনিয়ার মানুষ। তারপর অষ্টম ব্যাচের সময়ে ৬জন আন্তর্জাতিক সদস্য ছিল, তারা সৌদি আরব, ইরান, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও জার্মানি থেকে এসেছে। প্রথম ধাপ হলো, ডাইভিং প্রশিক্ষণ এবং দ্বিতীয় ধাপ হলো পানির নিচে প্রত্নতত্ত্বের সাইটে অনুশীলন। অত্যন্ত কঠোর প্রশিক্ষণের পর, দলের সদস্যরা আন্তর্জাতিক প্রত্যায়িত ডাইভিং সার্টিফিকেট এবং চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যুরোর পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব সার্টিফিকেটও পায়। তারা একটি খুব উচ্চ ডাইভিং ক্ষমতায় পৌঁছেছে।”

 

ভবিষ্যতের দিকে তাকালে চিয়াং বো চীনের পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব উন্নয়নে আশাবাদী। তিনি বলেন, “চীনের পানির নিচে প্রত্নতত্ত্ব শিল্পের একাডেমিক গুরুত্ব রয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা দেশের পানির নিচে প্রত্নতাত্ত্বিকদের সামুদ্রিক রেশমপথ নিয়ে গবেষণা চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেবো এবং সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক একাডেমিক বিনিময় ও সহযোগিতা করবো। অবশ্যই ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ভালো।”