প্রকৃতিই মানবজাতির রক্ষাকারী—চীনের বন রক্ষাকর্মীর গল্প
2021-09-03 18:22:52

প্রকৃতিই মানবজাতির রক্ষাকারী—চীনের বন রক্ষাকর্মীর গল্প

 

চীন হলো বিশ্বে জীববৈচিত্র্য খাতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি দেশ। বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ, আছে নানা অণুজীব; এই হলো জীববৈচিত্র্য এবং এর সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিকব্যবস্থা মানবজাতির জন্য অনেক উপকারী ও মানুষের জন্য কল্যাণকর। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ পৃথিবীতে প্রাণের অভিন্ন ভাগ্যের কমিউনিটি গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের প্রাকৃতিক সভ্যতা নির্মাণে অংশগ্রহণকারী, অবদানকারী ও নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে চীন সবসময় জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে।

 

চীনের হাইনান দ্বীপের মধ্য-দক্ষিণ দিকে একটি পর্বত আছে, পর্বতটি দেখতে তোতা পাখির মুখের মতো। তাই এর নাম রাখা হয়েছে তোতাপাখি পর্বত। তোতাপাখি পর্বত হলো হাইনান প্রদেশের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ সংরক্ষিত প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এটি চীনের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সেখানে আছে গুইসাপ, অজগর সাপ, ম্যাকাক্ বানরের মতো বিরল প্রাণী; আরো আছে বিলুপ্তপ্রায় জীবজন্তু ও উদ্ভিদ। স্থানটি হাইনান দ্বীপের বৃহত্তম নদী নানদু নদীর উত্সস্থল। তাহলে কীভাবে এই জায়গাটি সংরক্ষণ করা হয়েছে? মানবজাতি, বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ কীভাবে সেখানে সহাবস্থান করছে? সেখানে এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা এই আদিম বনভূমিতে নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছেন।

 

ফু হুই ছুয়ান, বর্তমানে হাইনান ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রাষ্ট্রীয় পার্কের তোতাপাখি পর্বত শাখার একজন বনরক্ষী। তিনি তোতাপাখি পর্বতঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন; ছোটবেলা থেকে বয়স্কদের সঙ্গে পাহাড়ে থেকেছেন, বেড়ে উঠেছেন। তিনি মনে করেন, এই পাহাড় তাঁদের জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

২০১১ সালে ফু হুই ছুয়ান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে তোতাপাখি পর্বতের একজন বনরক্ষী হন। তিনি বলেন, তিনি সেখানে বড় হয়েছেন; তাই স্থানীয় বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের সঙ্গে তিনি খুব পরিচিত। এটি তাঁর স্বাভাবিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে, বন রক্ষার কাজে যোগ দেওয়ার পর সত্যিকার অর্থেই এসব প্রাণী ও উদ্ভিদকে ভালোভাবে জানতে পেরেছেন তিনি।

 

তিনি  সাংবাদিককে বলেন, এক বছর তিনি ইনফ্রারেড ক্যামেরার মাধ্যমে বন্যপ্রাণী তত্ত্বাবধান প্রকল্পে অংশ নিয়েছিলেন। যখন তাঁরা ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখছিলেন, তখন একটি হলুদ রঙের হরিণের বনে হাঁটার ছবি তাঁদের সবাইকে অবাক করে দেয়। ছবিটা এত সুন্দর যে তাঁরা বিশ্বাস করতেও পারছিলেন না। হরিণের মুখের শান্ত ভাব এবং নিশ্চিন্ত বিচরণ, তার পিছনে বনভূমির ঘন গাছপালা—সব মিলিয়ে এক অবিশ্বাস্য সুন্দর ছবি। ফু সাংবাদিককে বলেন, সেই মুহূর্তে এই প্রাণীটিই সবচেয়ে সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর। তিনি আশা করেন, এই বিশ্বের সব প্রাণী এমন সুন্দর অবস্থায় সবসময় থাকতে পারবে।

 

ফু তখন থেকে সবসময় বন্যপ্রাণীর ইনফ্রারেড ক্যামেরা তত্ত্বাবধান প্রকল্পে কাজ করছেন। ক্যামেরার মাধ্যমে বনাঞ্চলের প্রাণীদের অবস্থার রেকর্ড করেছেন, তাদের বৈশিষ্ট্য ও থাকার পরিবেশ চিহ্নিত করার পদ্ধতি শিখেছেন। এত বছরে তিনি বনের অনেক জায়গায় ক্যামেরা স্থাপন করেছেন। আর এসব ক্যামেরায় অনেক উভচর সরীসৃপ প্রাণী ও পোকার অনেক চমত্কার মুহূর্ত ধরা পড়েছে। তিনি অনেক প্রাণীর পরিবারের একসাথে থাকার উষ্ণ মুহূর্তগুলোও ধারণ করেছেন। তিনি বছরের পর বছর ধরে তোতাপাখি পর্বতের বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের অজানা অনেক কিছু রেকর্ড করছেন। এখন তিনি সঠিকভাবে তিন শতাধিক ধরণের প্রাণী ও উদ্ভিদ সনাক্ত করতে পারেন; তিনি ভালোভাবে এসব প্রাণী ও উদ্ভিদ পর্যবেক্ষণের জন্য ড্রোন ক্যামেরা চালানোর লাইসেন্সও নিয়েছেন। সবাই বলে, তিনি হাইনানের বনরক্ষীদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষ।

 

তোতাপাখি পর্বতে ফু হুই ছুয়ানের মতো বন কর্মীর সংখ্যা তিন শতাধিক। তাদের প্রায় দশ বছরের বেশি কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তোতাপাখি পর্বতের গভীরে যাওয়ার পাহাড়ি পথে, নিবিড় ও সমৃদ্ধ গাছ-পালা যেন পুরু কম্বলের মতো বিছিয়ে রয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে তা যেন আকাশের দিকে উঠে গেছে। বন কর্মীদের বেলচা নিয়ে কোমর সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে অনেক কষ্ট করে উঠতে হয়। গিরিখাদ, বিষাক্ত সাপের পাশাপাশি পোচারদের ফাঁদে পড়ার বিপদও রয়েছে।

 

ফু জানান, একবার বন রক্ষার জন্য টহল দিতে গেলে পাহাড়ে তিন/চার দিন থাকতে হয়। তাঁদের এলাকার প্রতিটি কোণার অবস্থা দেখতে হয়। যদি কোনো লোক অবৈধভাবে বনের জমি দখল করে, বনের গাছ কাটে, বা অবৈধভাবে কোনো ফাঁদ তৈরি করে গুপ্তভাবে বন্যপ্রাণীর হত্যা করে, তাহলে তাঁরা নিশ্চয় বিষয়টি দেখবেন। তাঁরা বনজ সম্পদ ধ্বংস করা ঠেকাবেন এবং অপরাধীদের সঙ্গে লড়াই করবেন। এত বছরে তাঁরা অনেক বন্যপ্রাণীকে অপরাধীর গুলি ও ফাঁদ থেকে উদ্ধার করেছেন।

 

নিজের পা দিয়ে এই বড় পাহাড় হিসাব করা, স্থানীয় সব বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ রক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা, স্থানীয় মানুষদের পরিবেশ সংরক্ষণের জ্ঞান জানানো- সবই ফু ও তাঁর সহকর্মীর কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে, শুরুর দিকে স্থানীয় লোকজনকে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয় শেখানো কিন্তু একটি কঠিন ব্যাপার ছিল।

 

ফু সাংবাদিককে জানান, আমাদের গ্রাম জাতীয় উদ্যানের ঠিক পাশেই। অনেক স্থানীয় মানুষের চাষ করা গাছও তোতাপাখি পর্বতের আওতায় আছে। স্থানীয় লি জাতির মানুষের ঐতিহ্যিক চিন্তাধারা থেকে বের করে এনেছেন। মানুষ ভাবতো- পাহাড়ের কাছে থাকলে পাহাড়ের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করা উচিত, পাহাড়ে শিকার করা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই ফু-এর মতো বন কর্মীদের কাজ শুরুতে খুব কঠিন ছিল। একদিকে তাঁদের আত্মীয়স্বজন, আরেক দিকে দায়িত্ব।

 

বন রক্ষার কাজ সহজ করার জন্য স্থানীয় লোকজনের অনুন্নত জীবনযাপনের পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়। এতে তোতাপাখি পর্বতের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা পায়। এজন্য স্থানীয় সরকার আশেপাশের কমিউনিটিতে স্থানীয় লোকজনকে মধু চাষ এবং প্রাকৃতিক পর্যটন শিল্প উন্নয়নে সাহায্য দিয়েছে। ফু ও তাঁর সহকর্মীরাও গ্রামে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের তথ্য জানান। বহু বছর চেষ্টার পর স্থানীয় এলাকায় অনুন্নত জীবনযাপন পদ্ধতি দূর হয়। তোতাপাখি পর্বতের প্রাকৃতিক পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে, স্থানীয় কৃষকদের আয়ও অনেক বেড়েছে।

 

ফু জানান, সাধারণ লোকজনের আয় বৃদ্ধি হলো সবচেয়ে বাস্তব ব্যাপার। এখন অনেক কৃষক বুঝতে পেরেছে যে, শিকার করা বা গাছ কাটা অর্থ উপার্জনের একমাত্র পথ নয়। এখন সবাই ভালোভাবে এই পাহাড় রক্ষা করে। এতে স্থানীয় দৃশ্য আরো সুন্দর হয়েছে। বাইরের মানুষ আমাদের এখানে বেড়াতে আসতে আগ্রহী হয়; এর মাধ্যমে আয়ও হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ করলে কৃষকদের আয় বাড়তে পারে, যা উইন-উইন বিষয়।

 

ফু বলেন, এসব কাজে অংশগ্রহণ করতে পেরে তিনি খুব গর্ব বোধ করেন। নিজের পেশা ও পায়ের নিচের এই ভূমিকে তিনি আরো গভীরভাবে ভালোবাসেন।

ফু সাংবাদিককে বলেন, একজন প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণকারী হিসেবে তিনি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। তিনি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের নানা বিষয় শেখান। এর ফলে শিশুদের পরিবেশ সংরক্ষণের চেতনা অনেক বৃদ্ধি পায়। স্কুলে যা শেখানো হয়, শিক্ষার্থীরা তা ভালোভাবে মনে রাখে এবং বনে গিয়ে বন্যপ্রাণীর পর্যবেক্ষণ করে। এর মাধ্যমে লোকজন বনাঞ্চলকে উপলব্ধি করতে পারে এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রহস্য জানতে পারে।

 

বর্তমানে তোতাপাখি পর্বতকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকায় উন্নীত করা হয়েছে। সেখানে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এই রাষ্ট্রীয় পার্কও দেশের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার একটি স্থানে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। দশ বছর আগে কিছু কিছু স্থানে ছিল শুধু বালি আর বালি, কোথাও কোনো ঘাস ও গাছ ছিল না। এখন সেসব জায়গা বনভূমিতে পরিণত হয়েছে। বনে প্রতি এক কিলোমিটার পর পর একটি ইনফ্রারেড ক্যামেরা রাখা আছে। এখন দেখা যায় যে, এসব ক্যামেরায় তোলা ছবিতে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

 

ফু তোতাপাখি পর্বত এলাকায় জন্ম নেন এবং সেখানে বড় হন। তিনি স্থানীয় পরিবেশ পরিবর্তন সম্বন্ধে খুব ভালোভাবে জানেন। নীল আকাশ, সাদা মেঘ, পরিস্কার নদী ও সবুজ পাহাড়। বনে দেখা যায় পশুর পদাঙ্ক, শোনা যায় পাখির গান।

ফু বলেন, কেউ কেউ বলেন বনকর্মীরা হলেন রেইন ফরেস্ট রক্ষাকারী; আসলে না, রেইন ফরেস্ট সবসময় মানবজাতিকে রক্ষা করছে।

ফু সাংবাদিকের কাছে মনের কথা শেয়ার করেছেন, মানবজাতির প্রয়োজনীয় সব কিছুই প্রকৃতির প্রদান। তাই বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিজ্জ সম্পদ রক্ষা করার অর্থ মানবজাতির নিজের বাড়ি রক্ষা করা।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)