গত ২৪ আগস্ট টোকিও প্রতিবন্ধী অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন হয়েছে। এবারের আসরে প্রথম যে দলটি স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেছে, তারা হলো একটি শরণার্থী দল। তাদের পতাকা বহনকারী ছিলেন একজন বাহুবিহীন তরুণ। পতাকাটি তার পিঠে বাঁধা রাখা ছিল। তাকে অনুসরণ করে মাঠে প্রবেশ করে দলের বাকি সদস্যরা। শরণার্থী দলে ছিলেন ছয়জন প্রবন্ধী খেলোয়াড়। তাঁরা বিশ্বের লাখ লাখ গৃহহারা মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তাঁরা। হয়ে পড়েন পরিবার ও বন্ধুদের থেকে বিছিন্ন। তবে, কঠোর ও কষ্টকর যাত্রার মধ্য দিয়ে তাঁরা এখানে নতুন জীবন সৃষ্টি করতে আসেন।
তাঁরা অলিম্পিক গেমসে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের প্রচেষ্টা চালান। অন্য শরণার্থীদের উত্সাহীত ও অনুপ্রাণীত করতে চান তাঁরা। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ ছয়জনের সঙ্গে পরিচিত হব।
আব্বাস করিমী
তিনি একজন সাঁতারু। তিনি একজন আফগান শরণার্থী। জন্ম থেকে তাঁর বাহু দুটি ছিল না। অক্ষম ও সংখ্যালঘু জাতির সদস্য হওয়ার কারণে আফগানিস্তানে বৈষম্যের শিকার হন তিনি। তাঁর বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তিনি তুরস্কে পালিয়ে যান। সেখানে শরণার্থী হিসেবে চার বছর কাটানোর পর যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হন। ২০১৩-১০১৬ সাল পর্যন্ত যখন তিনি তুরস্কে ছিলেন, তখন তিনি চারটি শরণার্থী শিবিরে বাস করেন। এর মধ্যে দ্বিতীয়টা ছিল প্রতিবিন্ধীদের জন্য নির্মিত বিশেষ একটি শরণার্থী শিবির। সেখানে থাকার সময় তিনি প্রতিদিন সাঁতার কাটতেন এবং প্রতি দুদিনে একবার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন। প্রতিদিন তিনি এক ঘন্টা বাসে চড়ে সাঁতার কাটতে যেতেন এবং শিবিরে ফিরে আসতেন। তারপর আবার সুইমিং পুলে যেতেন। আট মাস ধরে তিনি এভাবে আসা-যাওয়া করেন। তিনি বিশ্বাস করেন ৩, সাঁতার তাকে আরও ভাল জীবন এনে দেবে। তিনি বলেন, “আশা করি, আমার মৃত্যুর পর মানুষরা আব্বাস করিমী নামটি মনে রাখবে।” তিনি প্রথম শরণার্থী ক্রীড়াবিদ, যিনি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক লাভ করেন । তাঁর মতে, শরণার্থী ক্রীড়াবিদের জন্য পদক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পদক শরণার্থীদেরকে উত্সাহ দেয় এবং তাদের আশাকে মজবুত করে।
ইব্রাহিম হুসাইন
তিনি একজন সাঁতারু এবং সিরিয়ার শরণার্থী। আহত একজন বন্ধুকে সাহায্য করতে গিয়ে বোমা হামলার শিকার হন তিনি। ডান হাঁটুর নীচের অংশ হারান তখন। ইব্রাহিমের বাবা একজন সাঁতার কোচ। তাই ছোট বেলা থেকে বাবার সাথে ইউফ্রেটিস নদীতে সাঁতার কাটতেন তিনি। ২০১১ সালে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে তিনি পরিবারের সাথে পালিয়ে যান। ২০১৪ সালে গ্রীসে পৌঁছান এবং সেখানে স্থানীয় একজন ডাক্তারের সাহায্যে প্রস্থেসিস নিয়ে আবারও হাটতে শুরু করেন। গ্রীসে তিনি আবার সাঁতার কাটা শুরু করেন। তিনি জানান, “ক্রীড়ার সময় আমি আমার হারানো পায়ের কথা ভুলে থাকতে পারি। সব অসুস্থতা ভুলে যেতে পারি, এবং আগের সব কষ্টও ভুলে গেছি।”
আলিয়া ইসসা
অলিম্পিক গেমসের প্রথম নারী শরণার্থী প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদ। তাঁর দলের সবচেয়ে তরুণ সদস্য। বিশ বছর বয়সী আলিয়া একজন সিরীয়া শরণার্থী। বর্তমানে তিনি গ্রীসে বাস করেন। লাঠি নিক্ষেপ নামের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তিনি। চার বছর বয়সে আলিয়া গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁর ভাষা দক্ষতা নেই। তাঁর গতিশীলতাও সীমিত। তিন বছর আগে তিনি ক্রীড়া শুরু করেন এবং দু’বছর আগে লাঠি নিক্ষেপ প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
আলিয়ার মতে, ক্রীড়া তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত এবং এর মাধ্যমে তিনি নিজকে আরও শক্তিশালি ও আত্নবিশ্বাসী মনে করেন। যদি কারো তাঁর মতো একটি শিশু থাকে, তাকে বাড়িতে না-রেখে খেলা শেখানোর আহ্বান জানান তিনি।
শাহরাদ নাসাজপুর
ইরানে জন্মগ্রহণকারী ক্রীড়াবিদ। সেরিব্রাল পালসির কারণে তাঁর শরীরের বাম দিকের চলাচলে অসুবিধা রয়েছে। ২০১৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে যোগাযগো করেন। রিও আলিম্পিক গেমসে শরণার্থী দল প্রতিষ্ঠার ধারণা উত্থাপন করেন তিনি। ২০১৬ সালে রিও প্রতিবন্ধী অলিম্পিক গেমসে তিনি ও ইব্রাহিম হুসাইন স্বাধীন প্রতিবন্ধী অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
প্রতিবন্ধী অলিম্পিক শরণার্থী প্রতিনিধির অগ্রদূত হিসেবে এবার তাঁর দলের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে দেখে তিনি খুব খুশি। তাঁর মতে, “যখন আমরা একটি দল হিসেবে আসি, তখন আরও বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করি। আশা করি, ভবিষ্যতে আমাদের দলের সদস্য আরও বেশি হবে।”
পারফেইট হাকিজিমানা
বুরুন্ডির একজন টেকউন্ডো প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদ। বুরুন্ডিতে তাঁর মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তাঁর বাম বাহু স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে যায়। তিনি রুয়ান্ডার একটি শরণার্থী শিরিরে বাস করেন। তিনি জানান, ক্রীড়া তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ক্রীড়াতে তিনি সুখ খুঁজে পেয়েছেন এবং প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অনেক বন্ধু মিলেছে তাঁর। তাঁর মতে, তাঁর ভবিষ্যত উজ্জ্বল। ক্রীড়ার মাধ্যমে তিনি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা কখনো পরিত্যাগ করবেন না। টেকউন্ডো সম্মান, মৈত্রী ও প্রতিযোগতার সম্পর্কিত একটি ক্রীড়া এবং নতুন এক দেশে টেকউন্ডোর মাধ্যমে তিনি নিজের অবস্থান পেয়েছেন।
আনাস খলিফা
একজন সিরীয় মানুষ। ২০১১ সালে যুদ্ধের কারণে তিনি পরিবার থেকে বিছিন্ন হন। ২০১৫ সালে তুরস্কের মাধ্যমে জার্মানীতে পালিয়ে যান এবং সেখানে ব্যাটারি বোর্ড স্থাপনের কাজ করেন। ২০১৮ সালে একটি দুর্ঘটনায় তাঁর মেরুদন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক বছর আগে, ফিজিওথেরাপিস্টের সাহায্যে তিনি কায়াকিং শুরু করেন। তাঁর কোচ একজন সাবেক অলিম্পিক পদক বিজয়ী। কঠোর প্রশিক্ষণ ও কোচের সাহায্যে আনাস দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করছেন। তিনি জানান, “প্রতিবার যখন প্রশিক্ষণ নেই, তখন ক্রীড়া আমাকে জানায়, আমি অনেক কিছু করতে সক্ষম। আমি নিজের অক্ষমতা ভুলে গেছি, আর নেই কোন মর্মবেদনাও।” (শিশির/এনাম/রুবি)