দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে গত বছরের মার্চের শেষ দিকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কয়েক দফায় উদ্যোগ নেওয়া হলেও মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় আর খোলা যায়নি স্কুল-কলেজ। এর ফলে ১৭ মাস ধরে শ্রেণিক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীরা।
এ দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৪ আগস্ট জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিল-ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যত বেশি সময় শিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে ততই তাদের স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা কমবে। সহিংসতা, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে পড়বে অনেক শিশু। তাই শিশুদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ।
বিশ্বসংস্থাটির পাশাপাশি শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও দেশের বিভিন্ন মহল থেকেও সরকারের ওপর চাপ রয়েছে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার। শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চমহল এ বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা-ভাবনা করছেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক আকার ধারণ করায় সে সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে হয়।
তবে, গত কিছু দিন ধরে করোনা পরিস্থিতির লক্ষ্যণীয় উন্নতি হয়েছে। ২৮ আগস্ট দীর্ঘ দু’মাস পর করোনায় দৈনিক মৃত্যু এক শো’র নিচে নেমে আসে। গত কিছু দিন ধরে সংক্রমণ হারও কমে ১৩-১৪ শতাংশে ওঠানামা করছে। অন্যদিকে টিকা কর্মসূচিতেও কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সরকার স্কুল-কলেজ খুলে দিতে চাইছে। এরই মধ্যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসন পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নন কন্ট্রাক্ট থার্মোমিটার, স্যানিটাইজার কেনা হচ্ছে।
সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেলে স্কুল-কলেজ খুলে কীভাবে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা হবে সে পরিকল্পনা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। প্রাথমিকের ক্ষেত্রে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি সপ্তাহে দুই দিন আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির একদিন করে ক্লাস হবে। মাধ্যমিকে জেএসসি, জেডিসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বেশি ক্লাস হবে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসাইনমেন্টের ওপর জোর দিয়ে চলবে পাঠদান। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে স্নাতক শেষবর্ষ ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হলে আনা হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনার কথাও বলা হচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত কয়েক দিনে বেশ ক’বার এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। সবশেষ গত ২৭ আগস্ট বলেছেন, সংক্রমণ হার ঠিক কত শতাংশে নামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে সে বিষয়ে ২ সেপ্টেম্বর কোভিড সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটির সঙ্গে বৈঠক হবে। তাদের মত পেলে জানানো হবে স্কুল-কলেজ খোলার চূড়ান্ত তারিখ।
অন্যদিকে আগামী এক মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৮ বছরের বেশি বয়সী সব শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া হবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। দু’সপ্তাহ সময় নেওয়া হবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্য। তারপর অক্টোবরের মাঝামাঝি খুলে দেয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়।
দীর্ঘ দিন পর স্কুলকলেজ খুলতে যাচ্ছে-এমন খবরে আনন্দ-উচ্ছ্বাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তবে একইসঙ্গে অভিভাবকদের মধ্যে করোনা নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে।
স্কুল-কলেজ খোলার বিষয়ে এখন সবাই তাকিয়ে আগামী ২ সেপ্টেম্বর কোভিড বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটি কী মতামত দেয় তার দিকে। তবে, কমিটির মতামত ইতিবাচক হবে বলেই ধারণ করা হচ্ছে। কারণ এরই মধ্যে জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোঃ সহিদুল্লাহ এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব জানিয়েছেন। ২৮ আগস্ট তিনি জানান, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি যে অবস্থায় রয়েছে তাতে পরীক্ষামূলকভাবে স্কুল-কলেজ খোলা যেতেই পারে।
তবে, একসঙ্গে সব শিক্ষার্থীকে স্কুলে আনা যাবে না বলে স্পষ্ট করে জানিয়েছেন ডা. সহিদুল্লাহ। এ ছাড়া কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত স্যানিটাইজিং সরঞ্জাম নিশ্চিত করার কথা বলেছেন তিনি। টানা দুসপ্তাহ পর্যবেক্ষণের পর পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে মত তার।
জাতীয় কমিটির এমন ইতিবাচক মনোভাব থেকে ধারণা করা যায় আগামী কয়েকদিনে করোনা পরিস্থিতির নাটকীয় কোনো অবনতি না হলে কমিটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষেই মত দেবে। আর সেক্ষেত্রে দীর্ঘ ১৭ মাস পর শ্রেণিকক্ষে ফিরবে আমাদের শিক্ষার্থীরা।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।