মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বার্ষিক ‘মানবপাচার প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ড অনুসারে মানবপাচার অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নানা দেশকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করেছে। এই প্রতিবেদন দ্বৈত মানদণ্ডে পরিপূর্ণ। এতে অন্যান্য দেশের মানবাধিকার রেকর্ডের সমালোচনা করা হয়েছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ‘আধুনিক দাসত্বের’ আচরণের কোন কথা উল্লেখ করা হয়নি। দেশটি নিজেকে ‘মানবাধিকার রক্ষক’ বলে দাবি করলেও তারা মানবপাচারের ‘নোংরা চুক্তি’ চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার অপরাধের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৬১৯ সালে যখন প্রথম কালো আফ্রিকানদের উত্তর আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রে মানবপাচার অপরাধ শুরু হয়। ১৭৭৬ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ ‘সব পুরুষকে সমানভাবে তৈরি করা হয়’ কথাটি লিখেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই দাসের মালিক ছিল। আমেরিকার ইতিহাসে এ রকমের অনেক ঘটনা আছে।
মানবপাচার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক খারাপ রেকর্ড রয়েছে। তারপরও তথাকথিত বার্ষিক ‘মানবপাচার প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে দেশটি। এমনকি এতে অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। সেই সঙ্গে নিজেকে ‘সেরা কর্মক্ষমতার তালিকায়’ রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পাচারবিরোধী দূত লুইস ডি বার্সা বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে একটি সাধারণ ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। যেমন- পাচার হলো অন্য দেশের একটি সমস্যা। কিন্তু প্রচুর পরিমাণ তথ্য, কেস ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে দেখা দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে এবং বিদেশি প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ‘উত্স, ট্রানজিট ও গন্তব্য দেশ’।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মানবপাচার হটলাইন ২০১৫ সালে ৫৭০০টিরও বেশি কল পেয়েছিল। চার বছর পর এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৯ সালে এফবিআই ১৮৮৩টি মানবপাচারের কেস রিপোর্ট করেছে; যা আগের বছরের তুলনায় ৫০০টিরও বেশি। একই বছর মার্কিন ফেডারেল প্রসিকিউটররা হিল্টন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলসহ ১২টি হোটেল গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তারা বলেন যে, তারা নারীদের যৌনদাসী হিসেবে পাচার করে এবং যৌন ব্যবসা থেকে লাভবান হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার বিরোধী ইনস্টিটিউটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেফ রজার্স মার্কিন ফক্স টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম যৌন ভোক্তা দেশ।
অভিবাসী ও শরণার্থীরা বিভিন্ন ধরণের পাচার এবং অমানবিক আচরণের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। মিডিয়া প্রতিবেদন ও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অভিবাসন নীতি এবং দুর্বল আইন প্রয়োগের কারণে, ২০১৯ অর্থবছরে সাড়ে আট লাখেরও বেশি অভিবাসীকে মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে আটক করা হয় এবং ৬৯,৫৫০ অভিবাসী শিশুকে আটকে রাখা হয় এবং তারা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। চিকিত্সা, খাদ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার অভাবের পাশাপাশি তারা নানা সমস্যায় রয়েছেন।
কোভিড-১৯ মহামারি তাদের জন্য নতুন ট্র্যাজেডি তৈরি করেছে। ব্রাজিলের সাবেক পর্যটনমন্ত্রী, সাবেক উন্নয়ন, শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী আলেসান্দ্রো এক পর্যালোচনা প্রবন্ধে লিখেছেন: কোনও ভাইরাস পরীক্ষা এবং নীতিগত গ্যারান্টি না থাকায় মার্কিন আটক কেন্দ্রগুলিতে বিপুল সংখ্যক অবৈধ অভিবাসীদের প্রত্যাবাসন অব্যাহত রয়েছে। ফক্স টেলিভিশন ১৭ অগাস্ট জানায়, সাত হাজারেও বেশি কোভিড-১৯ রোগী অভিবাসীদের নির্বাসিত করা হয়েছে।
খারাপ মানবাধিকারের রেকর্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভালো পারফরম্যান্স’ দাবি করার সুযোগ কোথায়?
‘মানবপাচারের প্রতিবেদনটি’ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের বিষয়ে একতরফা মূল্যায়ন। এটি কোনও আন্তর্জাতিক মানের প্রতিনিধিত্ব করে না।
তাই, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নিজের অপরাধের পরীক্ষা ও আত্ম-সমালোচনা করা এবং সংশোধন করা। পাশাপাশি, অন্য দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা বন্ধ করা এবং নিজের নাগরিকদের প্রতি মনোনিবেশ করা।
জিনিয়া/তৌহিদ/শুয়েই