বাংলাদেশে করোনা মহামারি মোকাবেলায় গত দেড় বছরেরও বেশি সময়ে ভালো-মন্দ অনেক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে গত ১৬ আগস্ট চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে বাংলাদেশে টিকা বোতলজাতকরণের যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছ তাই সম্ভবতো মহামারি মোকাবেলায় সবচেয়ে ফলপ্রসু উদ্যোগ। আজকের সংবাদ পর্যালোচনায় আমরা বিষয়টির দিকে নজর দেব। তবে তার আগে একটা বিষয় একটু পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার।
চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় ও ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেডের যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে তা কিন্তু বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের নয়। বরং টিকা বোতলজাতকরণের। টিকা উৎপাদনের কোনো প্রযুক্তি সিনোফার্ম বাংলাদেশকে দিচ্ছে না। কাজেই ইনসেপ্টা টিকা তৈরি করবে এটা ঠিক নয়। যদিও অনেক গণমাধ্যমে একে যৌথ টিকা উৎপাদন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে বা হচ্ছে।
বিষয়টা খোলাসা করা যাক। সিনোফার্ম আসলে তাদের উৎপাদিত টিকার বাল্ক দেবে আমাদের। এই বাল্ক তবে কি? বাল্ক হলো উৎপাদিত টিকা সংরক্ষণের বড় আকারের পাত্র বিশেষ। সিনোফার্মের কাছ থেকে ইনসেপ্টা বাল্ক পাবে, আর সেগুলোর ফিল-ফিনিশ বা বোতলজাত করবে। কাজেই এটা কোনোভাবেই উৎপাদন বলা যায় না। এমন অনেক ওষুধই বিদেশ থেকে এনে দেশে বোতলজাত করা হয়।
তবে,টিকা উৎপাদিত না হোক, বোতলজাতকরণেও কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপক লাভবান হবে।
প্রথমত: টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য।
দ্বিতীয়ত: আমদানি করা টিকার চেয়ে কম দামে পাওয়া যাবে এ টিকা।
তৃতীয়ত: নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে।
গত কিছু দিন ধরে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কিছুটা নিম্নমুখী। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমতির দিকে। টানা বেশ কদিন মৃত্যু দুশোর নিচে আর সংক্রমণ ৩২ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশের কোঠায় নেমে এসেছে। এ জন্য টিকা কর্মসূচির একটা বড় অবদান রয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
সিনোফার্মের কাছ থেকে ইনসেপ্টা পর্যাপ্ত বাল্ক পেলে মাসে ৪ কোটি পর্যন্ত টিকা বোতলজাত করা সম্ভব হবে ইনসেপ্টার পক্ষে। তবে মাসে কমবেশি দেড় কোটি টিকা বোতলজাত করার পরিকল্পনা রয়েছে ইনসেপ্টার। প্রাথমিকভাবে মাসে ৫০ লাখ টিকা সরবরাহ করবে ইনসেপ্টা। আর মাস তিনেকের মধ্যেই তারা তা করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে দরকার ২৬ কোটির মতো টিকা। চীনের কাছ থেকে ৬ কোটি টিকা কেনার কথা। এরই মধ্যে বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া গেছে তিন কোটির বেশি। সে হিসেবে বাকি টিকা সরবরাহ করতে ইনসেপ্টার খুব বেশি দিন লাগবে না। এতে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত হবে। এটিই এ চুক্তির সবচেয়ে কাঙ্খিত ও বড় প্রাপ্তি।
টিকা আমদানির জন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ইনসেপ্টার সরবরাহ করা টিকার দাম কত পড়বে তা জানা না গেলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় আমদানি করা টিকার চেয়ে এর দাম নিশ্চয় কম হবে। সরকার এ টিকা কিনবে ইনসেপ্টার কাছ থেকে। টিকার গুণগত মানরক্ষা ও সাশ্রয়ী মূল্যে পেতে সরকারকে তদারকির পরামর্শ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের তরফে।
আর উদ্বৃত্ত টিকা বাংলাদেশ রপ্তানি করতে পারবে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর কাছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয় তা নয়, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক মহামারি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যেমনটা বলছিলেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি জানান, চীন এ পর্যন্ত বিশ্বের ১০০টি দেশকে করোনা টিকা সরবরাহ করেছে। অনেক দেশে যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করছে। এটা শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। এটা বৈশ্বিক মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীনের জোরালো অংশগ্রহণ।
টিকা নিয়ে এমন আনন্দের খবরের মধ্যে একটুখানি সতর্কবার্তা। সম্প্রতি ঢাকার দক্ষিণখানে ফার্মেসিতে পাওয়া গেছে মডার্নার করোনা টিকা- যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনী। কালোবাজারে চলে গেছে টিকা। স্বাস্থ্য ডিজি অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, বাজারে টিকা বিক্রির ঘটনা তদন্ত চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হব।
এটা খুব ভালো কথা স্বাস্থ্য ডিজি ব্যবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু ঘটনা ঘটার আগেই যদি সতর্কতা অবলম্বন করা যায় সেটাই মঙ্গলজনক হবে। টিকা শুধু পেলে হবে না, এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাটাও জরুরি।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।